সশস্ত্র তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন আফগানিস্তানের নারীরা।
দেশটির উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের সড়কে রাইফেল কাঁধে তুলে কুচকাওয়াজ করছেন শত শত নারী।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল দখলে তালেবানের তৎপরতা বাড়তে থাকার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অস্ত্র হাতে ছবি প্রকাশ করছেন নারীরা।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে জানানো হয়, সম্প্রতি মধ্যাঞ্চলীয় ঘোর প্রদেশে হয়েছে আফগান নারীদের অন্যতম বড় অস্ত্র মিছিলটি। তালেবানবিরোধী স্লোগানে মুখর ছিলেন তারা।
রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা আর অনভিজ্ঞতার কারণে এখনই তালেবানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামছে না এই নারীরা।
তালেবানের শাসনে ফিরে গেলে নারী ও স্বজনদের কী হাল হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে, তা মনে করিয়ে দেয়াই মিছিলের লক্ষ্য।
ঘোর প্রদেশে মিছিলের আয়োজক দলের প্রধান ও কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া হালিমা পারাসতিশ বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উৎসাহ জোগাতে চান অনেক নারী, প্রতীকীরূপে। কিন্তু এমন অনেক নারীও আছেন যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চান।
‘আমিও তাদের একজন। আমি ও আরও অনেক নারী বিষয়টি প্রায় এক মাস আগে গভর্নরকেও জানিয়েছি। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে এবং লড়াই করতে প্রস্তুত।’
প্রদেশটির গভর্নরও একজন নারী। তার নাম আব্দুলজহির ফাইজজাদা। ফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, প্রাদেশিক রাজধানী ফিরোজকোহের সড়কে এরই মধ্যে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন কিছু নারী; গোষ্ঠীটির সহিংসতার বলিও হয়েছেন তারা।
ফাইজজাদা বলেন, ‘এই নারীদের বেশিরভাগই তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সম্প্রতি পালিয়েছেন। নিজ নিজ গ্রামে যুদ্ধ দেখে এসেছেন তারা। যুদ্ধে সন্তান, ভাইদের হারিয়ে ক্ষুব্ধ তারা।’
ঘোর প্রদেশে নারীদের সশস্ত্র মিছিল ও কুচকাওয়াজ। ছবি: ফেসবুক
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি না পেলে অস্ত্র চালনায় অনভিজ্ঞ নারীদের নিজে প্রশিক্ষণ দেবেন বলেও জানান ফাইজজাদা।
তালেবানের রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থার বিরোধী ঘোর প্রদেশের বড় অংশ। সেখানকার নারীদের মধ্যে মাথায় কাপড় দেয়ার চল থাকলেও বোরকা পরেন না তারা। গ্রামে, মাঠে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন তারা।
অন্যদিকে প্রদেশটির তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে কৃষিকাজ, পশুপালনেও নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে গোষ্ঠীটি; পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের বাইরে বের না হওয়ার আদেশ দিয়েছে। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠান বা অন্য আয়োজনেও নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে কেবল পুরুষদের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
এমন অনেক এলাকা ছেড়ে পালানো নারীরা তালেবানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মিছিলে অংশ নিচ্ছেন স্বেচ্ছায়।
তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ঘোরের গভর্নর ফাইজজাদা আরও বলেন, “এই নারীরা বলেছেন, ‘আত্মরক্ষার সুযোগ ছাড়াই আমাদের হত্যা করা হচ্ছে, আঘাত করা হচ্ছে। তাহলে কেন আমরা লড়াই করবো না?’”
আফগানিস্তানের শতাধিক জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন তালেবান। এর বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চল। যেমন উত্তরের বাদাখশান প্রদেশ।
২০ বছর আগে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানেও এসব অঞ্চলে তালেবানবিরোধীরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী।
বর্তমানে এমন অনেক প্রদেশের রাজধানী দখল করেছে তালেবান।
দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে এরই মধ্যে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, অবাধ চলাচল, তাদের পোশাক-আশাকে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তালেবান। একটি এলাকায় নারীদের আপাদমস্তক ঢেকে বোরখা পরারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আফগানিস্তান অ্যানালাইসিস নেটওয়ার্কের নতুন এক জরিপে উঠে এসেছে দেশটিতে চরম রক্ষণশীল গ্রামাঞ্চলের নারীরা শিক্ষা গ্রহণ, স্বাধীন চলাচল ও পরিবারে বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে আগের চেয়ে বেশি উৎসাহী। প্রান্তিক ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর নারীদের নিয়ে জরিপটি করা হয়।
তালেবানের শাসন তাদের নিয়ে যাবে উল্টো পথে।
উত্তরের জওজযান প্রদেশে নারীদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘটনা নতুন নয়। সেখানকার এক সাংবাদিক বলেন, ‘শখ করে কোনো নারী লড়াই করতে চায় না। আমি শুধু চাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আর সহিংসতা থেকে অনেক অনেক দূরে থাকতে।
‘যুদ্ধে যেতে আমাকে আর আমার মতো অনেক নারীকে বাধ্য করেছে পরিস্থিতি।’
প্রাদেশিক রাজধানীতে অস্ত্র চালনার একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন এই তরুণী। শহরটি বর্তমানে তালেবানের কবজায়। তাই তালেবানের হাতে তথ্য যাওয়ার ভয়ে নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
তিনি বলেন, ‘যারা নারীদের সঙ্গে এমন পশুর মতো আচরণ করে, আমি চাই না যে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক আমার দেশ। আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি এটাই জানাতে যে যদিও আমাদের লড়তে হয়, তো আমরা লড়ব।’
বিশোর্ধ্ব এই তরুণী জানান, তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অর্ধশত নারী। অনভিজ্ঞ হলেও তালেবানের মুখোমুখি হলে একটি সুবিধা পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি।
তিনি বলেন, ‘নারীদের সঙ্গে লড়াইয়ে মৃত্যুকে ভয় পায় তালেবান। তালেবান সদস্যদের কাছে এটা লজ্জার।’
ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদীদের কাছে যুদ্ধে নারীদের কাছে পরাজয়ের চেয়ে বড় অপমান কিছু নেই। সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের সদস্যরাও পুরুষের হাতে মৃত্যুকে নয়; বরং কুর্দি নারী সেনাদের হাতে মৃত্যুকে ভয় পেত।
অস্ত্র তুলে নেয়া আফগান নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বিরল হলেও নতুন কিছু নয়; বিশেষ করে দেশটির তুলনামূলক কম রক্ষণশীল এলাকাগুলোতে।
গত বছর বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন কামার গুল নামে এক আফগান কিশোরী। চোখের সামনে তার মা-বাবাকে হত্যা করেছিল তালেবানরা। ঘাতক তালেবান সদস্যদের মধ্যে একজন ছিল ওই কিশোরীর স্বামীও।
নিজের ছোট ভাইকে বাঁচাতে ওই সময় অস্ত্র হাতে তুলে নেয় কামার গুল। একা লড়াই করে কয়েক তালেবান সদস্যকে হত্যা করে; বাকিরা পালিয়ে যায়।
বাঘলান প্রদেশের নারী বিবি আয়শা হাবিবি। আশির দশকে সোভিয়েত আগ্রাসন ও তারপরে গৃহযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানের একমাত্র নারী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। কমান্ডার কাফতার বা কবুতর নামে সুপরিচিত তিনি।
বালখ প্রদেশের উত্তরে চারকিন্ত জেলায় যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারির একজন লড়াকু সেনা ৩৯ বছর বয়সী নারী সেলিমা মাজারি। জেলাটির গভর্নরও তিনি।
তবে আফগানিস্তানের নারীদের এসব ঐতিহাসিক অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায় তালেবান।
গোষ্ঠীটির মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘নারীরা কোনোদিন আমাদের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলবে না। তারা অসহায়। পরাজিত শত্রুপক্ষ তাদের উসকে দিচ্ছে। তারা লড়াই করতে পারে না।’
তালেবানের দাবি, আফগান নারী যোদ্ধাদের গল্পগুলো শুধুই অপপ্রচার। পুরুষরা যেন পরিবারের নারী সদস্যদের যুদ্ধের অনুমতি না দেয়, সে বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে গোষ্ঠীটির।
গত দুই দশকে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন অনেক নারী। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে।
তবে পুরুষ সহকর্মীদের হয়রানি আর বৈষম্যের শিকার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারিতে নারী সেনাদের উপস্থিতি বিরল।