প্রথমে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে আদিবাসী শিশুদের একটি আবাসিক স্কুলপ্রাঙ্গণে অপ্রাপ্তবয়স্ক ২১৫ জনের দেহাবশেষের সন্ধান। মাস না গড়াতেই যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের সাসকাচোয়ান প্রদেশের এক আবাসিক স্কুলপ্রাঙ্গণে শনাক্ত হয় আরও ৭৫১টি পুরোনো অচিহ্নিত কবর।
ধারাবাহিক এসব ঘটনায় বিব্রত হালের অভিবাসীবান্ধব উদার রাষ্ট্র কানাডা।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ‘যে আঘাত ও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে কানাডার আদিবাসীরা যাচ্ছেন, সে বোঝা কমানোর দায়িত্ব পুরো দেশের।’
তবে ট্রুডোর এই বক্তব্যেও দৃশ্যত কমেনি কানাডার আদিবাসীদের মানসিক চাপের বোঝা। দুই বারে প্রায় এক হাজার অচিহ্নিত কবর শনাক্তের ঘটনায় আবারও দগদগে হয়ে উঠেছে তাদের পুরোনো ক্ষত।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্ষত দেশটির ঔপনিবেশিক শাসনামলে আদিবাসী নির্মূলের লক্ষ্যে চালানো নির্মম নির্যাতনের।
গত ২ জুন একসময়ের মেরিভ্যাল ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে কবরগুলো খুঁজে বের করার কাজ শুরু করে স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠী কাওয়েসেস ফার্স্ট নেশন। সাসকাচোয়ানে এ ধরনের কবর শনাক্তের ঘটনা এটাই প্রথম।
ওই এলাকায় অচিহ্নিত প্রাচীন কবর শনাক্তে ২০১৯ সালে গোষ্ঠীটিকে ৭০ হাজার কানাডিয়ান ডলারের অর্থ সহায়তা দেয় স্থানীয় ক্যাথলিক প্রশাসন।
এ ছাড়া রোমান ক্যাথলিক চার্চ যত বছর স্কুলটি চালিয়েছে, সেই সময়ে কাওয়েসেস আদিবাসীদের মৃত্যুর খতিয়ানও কাওয়েসেস ফার্স্ট নেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তবে নিজেদের অঞ্চলে অচিহ্নিত কবর শনাক্তে কাওয়েসেসরা কার্যকর পদক্ষেপ নেয় মূলত মে মাসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপসে ২১৫ আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষের সন্ধান মেলার পর।
মেরিভ্যালে অচিহ্নিত কবর শনাক্তে ব্যবহার করা হয় গ্রাউন্ড-পেনিট্রেটিং রাডার। যন্ত্রটি মেরিভ্যালের মাটিতে মোট ৭৫১টি জায়গা কবর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলা হচ্ছে, ১০ শতাংশ যান্ত্রিক ত্রুটি ধরে নিলেও ছয় শতাধিক কবর আছে এলাকাটিতে।
সাম্প্রতিক কবর আবিষ্কারের ঘটনায় স্থানীয় আর্চবিশপ ডন বোলেন বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কাওয়েসেস ফার্স্ট নেশনের প্রধান কাডমুস ডেলোরমিকে।
এতে ‘গির্জা কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের পাপ ও ব্যর্থতার জন্য’ আবার ক্ষমা চেয়েছেন আর্চবিশপ। তিনি অনুরোধ করেছেন দেহাবশেষের পরিচয় শনাক্তে আদিবাসী গোষ্ঠীটিকে গির্জা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সহযোগিতা দেয়ার।
আদিবাসীদের ওপর ঔপনিবেশিকতার ক্ষত
কানাডার আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে আদিবাসী শিশুদের ওপর নির্যাতনের পুরোনো ক্ষতকে জাগিয়ে তুলেছে এসব কবর শনাক্তের ঘটনা।
সাসকাচোয়ান প্রদেশের ৭৪টি আদিবাসী গোষ্ঠীর জোট ফেডারেশন অফ সভরেইন ইনডিজেনাস নেশন্সের (এফএসআইএন) প্রধান ববি ক্যামেরন বলেন, ‘আদিবাসীদের নির্মূলের চেষ্টা চালানো একটি জাতি হিসেবে একদিন পরিচিত হবে কানাডা। এটা তো কেবল শুরু।’
আদিবাসী নিপীড়ন কার্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত কানাডার আবাসিক শিক্ষাব্যবস্থা।
গত ১০০ বছরের বেশি সময়ে এসব স্কুলে আদিবাসী শিশুদের ওপর চলা নির্মমতা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই কানাডা সরকারের হাতে। ফলে অপরাধীদের কখনো জবাবদিহিতার মুখেও পড়তে হয়নি।
১৮৩১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ ব্যবস্থার আওতায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল দেড় লাখ আদিবাসী শিশুকে। তাদের জোর করে খ্রিস্টানদের আবাসিক স্কুলে রেখে দেয়া হতো, খেতে দেয়া হতো না; চালানো হতো শারীরিক ও যৌন নির্যাতন।
কানাডার তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করত ক্যাথলিক চার্চগুলো।
কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন ২০১৫ সালে ‘সাংস্কৃতিক জেনোসাইড’বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এই জেনোসাইডের কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল সাসকাচোয়ানের প্রদেশে সদ্য আবিষ্কৃত মেরিভ্যাল স্কুলটির সমাধিক্ষেত্রের কথা।
প্রদেশটির আদিবাসী গোষ্ঠী কাওয়েসেস ফার্স্ট নেশন অধ্যুষিত এলাকায় ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরের বেশি সময় চলেছে স্কুলটির কার্যক্রম।
এফএসআইএনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিদার বিয়ার সত্তরের দশকে মেরিভ্যাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে সময় স্কুলটিতে ছোট একটি সমাধিক্ষেত্র তিনি দেখেছিলেন বলে জানান।
সমাধিক্ষেত্রটি আসলে কত বড়, বৃহস্পতিবার তা জানার পর বিস্মিত এই নারী বলেন, ‘এরপর তো স্কুলের ভেতরে একা একা হেঁটে বেড়ানোও কষ্টকর হয়ে যাবে। সেখানকার দুঃখ তাড়িয়ে বেড়াবে।
‘প্রতিটি আবাসিক স্কুল এলাকাতেই এখন এ রকম একটা অশুভ বিষয় ছায়া হয়ে থাকবে।’
নানা বিতর্কের মুখে ১৯৯৯ সালে মেরিভ্যাল স্কুলটি ভেঙে দিয়ে সেখানে অনাবাসিক একটি স্কুল চালু করা হয়।
চলতি মাসের শুরুতে ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস দুঃখ প্রকাশ করলেও তাতে মন গলেনি কানাডার ভুক্তভোগী আদিবাসীদের। কারণ তিনি বা এসব স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রোমান ক্যাথলিক চার্চ এসব ঘটনায় সরাসরি ক্ষমা চায়নি।