চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনি রোববার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তোলার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে দেশজুড়ে।
পরীমনির ওই পেজের ফলোয়ার ৯১ লাখের বেশি। তার আলোচিত ওই পোস্টে সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন। অনেকেই জানিয়েছেন ক্ষোভ, সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে এর মধ্যে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট পড়েছে ৫৩ হাজারের বেশি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য।
একজন নারী ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তোলার পর তাকে উপহাস করার এ ধরনের মানসিকতা নিয়েও আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সমাজ ও মনোবিশ্লেষকেরা বলছেন, ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তোলা নারীর পোস্টে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্টকে বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকাশ। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাগামহীন ব্যবহার উসকে দিচ্ছে মানসিক বিকৃতিকে।
পরীমনির পোস্টে ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তাদের কারও দাবি, ভুল করে এ ধরনের রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন। আবার অনেকে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, কেউ কেউ দেখিয়েছেন বেপরোয়া মনোভাব।
পরীমনির পোস্টে হা হা রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন আশরাফ হোসেন নিপু। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ, বিশেষ কারণেই দিয়েছি। যেহেতু বিশেষ কারণ তাই এটি সিক্রেট। বলব না।’
ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে ফেসবুকে পরীমনির পোস্টতার মন্তব্যটি প্রতিবেদনে যুক্ত করা হবে জানানো হলে নিপু জানান, এতে তার কোনো পরোয়া নেই। বরং প্রতিবেদনে যেন তার ছবি দিয়ে দেয়া হয়। এমনকি নিউজের লিংকও পাঠানোর অনুরোধ করেন নিপু।
আরিফুল ইসলাম অভি নামে একজন বলেন, ‘বিশেষ কোনো কারণ নাই, ইচ্ছা হয়েছে তাই হা হা রিঅ্যাক্ট দিয়েছি। সাংবাদিকদের ডেকে এনে যে ভাবটা করতেছিল সেটা হাস্যকর লাগছে।’
পরীমনির পোস্টে সাংবাদিক কাহহার সামি হা হা রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন। এর যুক্তি দিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু সাংবাদিক তার (পরীমনি) মনের মতো নিউজ না করায় এমন অসহায়ত্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর তাই তার এমন অসহায়ত্বের অবস্থা দেখে হাসি পেল। হয়তো এটা তার জন্য শিক্ষা। তবে আমি চাই অপরাধীর বিচার হোক।’
হা হা রিঅ্যাক্ট দেয়া অন্তত ২০ জনকে মেসেঞ্জারে টেক্সট করা হলেও তারা উত্তর দেননি। অনেকে আবার নিউজবাংলার প্রতিবেদকের কাছে কারণ জানার পর তাকে ব্লক করে দেন।
পরীমনির পোস্টে হা হা রিঅ্যাক্ট দেয়া অনেকেই বলছেন, তারা কোনো ভুল করেননিহা হা রিঅ্যাক্ট দেয়া কয়েকজন অবশ্য বলছেন, তারা ভুল করেছেন। এমন একজন আশাকুল ইসলাম তানজিল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি এটা ভাবতেই পারি নাই যে সিরিয়াস ইস্যু। পড়ে দেখি এটা সিরিয়াস। তখন হা হা রিঅ্যাক্ট তুলে নিয়েছি।’
ওয়াজেদ আলী নামের একজন বলেন, ‘আমি প্রথমে বুঝিনি এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। ভেবেছি হয়তো কোনো সিনেমা বা এমন কিছু। পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জেনে আমি হা হা রিঅ্যাক্ট সরিয়ে নিয়েছি।’
হা হা রিঅ্যাক্ট দেয়া আফসানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি না বুঝেই দিয়েছি আর এর জন্য আমি লজ্জিত। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে আর একটা মাধ্যমে পড়ে যখন বুঝেছি, তখন আমি তা রিমুভ করে দিয়েছি।’
একজন মানুষ তার ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তোলার পর তাকে উপহাসের মনস্তত্ত্ব জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে সমাজ ও মনোবিশ্লেষকদের সঙ্গে।
‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’-এর সমন্বয়ক জিনাত আরা হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে এখন এই গ্রুপের সংখ্যাটাই বেশি। আগে সংখ্যাটা এত বেশি ছিল না। আমরা দেখেছি এমন অনেকে ছিলেন, যারা নেতিবাচক ধারণা রাখলেও সেটা প্রকাশ করতে চাইতেন না। এর কারণ ছিল, তারা ভাবতেন যে আমি সাপোর্ট পাব কি না। তবে এখন সেটি বেড়ে গিয়েছে।’
জিনাত বলেন, ‘হা হা রিঅ্যাক্টের এত সংখ্যা দেখে অন্যরাও ভেবে নিয়েছেন তারা একা না। বরং পরীমনির সঙ্গে যারা এখন আছেন তারাই সমস্যায় পড়বেন কি না সেটি দেখার বিষয়। এর মানে, যারা ইতিবাচক তাদের সংখ্যা কমে গিয়েছে।’
নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা এই অধিকারকর্মী বলেন, ‘কিছু মানুষ মনেই করতে থাকে এসব মেয়ে (অভিনয়শিল্পে জড়িতরা) এমন বা নারীর প্রতি এসব ঘটনা বানোয়াট। নারীরা খারাপ দেখেই এমন হয়, এটাও অনেকে মনে করেন। তারা বিনোদন দেখে, কিন্তু এটাকে যে একটা সম্মানজনক জায়গা হিসেবে দেখা বা পরীমনি যে সম্মানজনক জায়গায় আছেন- তিনিও যে ভালনারেবল হতে পারেন, এটা তারা ভাবে না।
‘নারীকে যেভাবে পুরুষ দেখতে চায়, ঠিক সেটির এক পা এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু তাকে কটাক্ষ করা হয়। আজ পরীমনি নায়িকা বলে তাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। আবার এই যে মুনিয়া কেন এত টাকার ফ্ল্যাটে থাকবে সেটি নিয়েও কটাক্ষ করা হয়। কিন্তু এগুলো তো আলাদা বিষয়। এখানে যে অপরাধটা হয়েছে সেটির বিচার চাইতে হবে, করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক মনে করেন, অনেকে না জেনে বা তথ্যগত ভুল ধারণার কারণেও এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে সব ক্ষেত্রে জেন্ডার ইস্যুটা বড় নয়। আমিও এমন শিকার হয়েছি। এখানে সত্য যে জিনিস সেটা দেখার বিষয় রয়েছে।
‘এখন অনেকেই না বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখান। ঘটনার পেছনে আসলে কী সেটা জানা থাকে না। এখন ফেসবুক, ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ঘটনা। সেখানে কে দোষী আর কে দোষী না, সেটা প্রমাণিত হওয়ার আগেই স্ট্যাটাস বা পোস্ট দেয়া হচ্ছে। এটা আগে বন্ধ করা দরকার।’
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ধরেন আমার বিরুদ্ধে একটা সংবাদ হয়েছে। সেটি ছড়িয়ে পড়ছে। পরে যখন সেটা প্রমাণ হয় না বা বিস্তারিত আসে তখন আর কতজন এটা পড়ে?’
ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন পরীমনিঅন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহফুজা খানমের মতে, এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পেছনে বড় কারণ মূল্যবোধের পরিবর্তন।
মাহফুজা খানম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের জন্য মানুষের যে সহানুভূতি হয় সেটাকে আমরা ভ্যালুজ বলে থাকি। এটা মানুষের জীবনে অনেক দিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এটি পাস হয়। তবে আস্তে আস্তে এর পরিবর্তন হতে থাকে।
‘আমি যদি ৫০ বছর আগে আমাদের যে ভ্যালুজের সঙ্গে রিসেন্ট ভ্যালুজের কম্পেয়ার করি, তাহলে একটা পরিবর্তন দেখতে পাব। এই পরিবর্তনটা খুব আস্তে আস্তে হয়। এটি সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। তেমন এটিও চেঞ্জ হচ্ছে। যে ভ্যালুজগুলোকে আমরা বেশি প্রাধান্য দিতাম সেটি এখন চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে।’
বর্তমান প্রজন্মে দুটি ভ্যালুজকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভ্যালুজকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এখন মা-বাবা দুজনেই চাকরি করছেন। ব্যস্ততা বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের সময় দিতে পারছেন না। এই সমস্ত বিভিন্ন কারণে এমন হচ্ছে। যার কারণে ভ্যালুজটা এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনে প্রবাহিত হচ্ছে না।’
মাহাফুজা খানম উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা স্টাডি করেছি। সেখানে দেখেছি যারা ইসলামিক ওয়েতে কাপড় পরেন বা সেগুলো লালন করেন, তাদের সেই ভ্যালুজ বেশি হয় কি না। তবে আমি কিন্তু তা পাইনি। তারা ওই বিষয়টি লালন করেন মানেই যে ওই ভ্যালুজ ধারণ করবেন তা নয়।’