আফ্রিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দেশ মিসরের ট্রান্সজেন্ডার নারী ফরিদা রামাদান। রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি।
লৈঙ্গিক ও জেন্ডার পরিচয়ের জেরে সৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য বন্ধে তার লড়াই। সবার মতো সমান অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করতে চান। এ লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সে লড়াইয়ের গল্প বলেছেন ফরিদা।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষাৎকারে মিসরে বেশিরভাগ মানুষ এলজিবিটিকিউ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার) সম্প্রদায়ের প্রতি হীন ধারণা পোষণ করেন বলে জানান ফরিদা।
সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় মাথায় রঙিন স্কার্ফ, চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক পরেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই ট্রান্সজেন্ডার নারী।
তিনি জানান, মিসরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত দামিয়েত্তা শহরে ছেলে হিসেবে বেড়ে ওঠা শুরু তার। কৈশোরের শুরুতে পরিবারকে জানান, নিজেকে ছেলে মনে করেন না তিনি।
ফরিদা বলেন, ‘চরম অবজ্ঞা আর অকল্পনীয় তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছিলাম আমি।’
বয়স ২০ বছর পার হওয়ার পর ঘর-পরিবার ছাড়েন ফরিদা। লিঙ্গ নির্ধারণ অস্ত্রোপচার জিসিএসের জন্য প্রশাসনের কাছ অনুমতি আদায়ে তার দীর্ঘ লড়াই শুরু হয় ২০০০ সালে। শেষ পর্যন্ত ছুরিকাঁচির নিচে তিনি গিয়েছেন আরও ১৫ বছর পর।
অস্ত্রোপচারের অনুমতি পাওয়ার চ্যালেঞ্জ
মিসরে সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বেদায়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জানান, দেশটিতে ট্রান্সজেন্ডারদের স্বীকৃতি নেই। দেশটিতে লৈঙ্গিক পরিবর্তনের অস্ত্রোপচারের জন্য ইজিপশিয়ান মেডিক্যাল সিন্ডিকেটের অনুমতি দরকার হয়।
সিন্ডিকেট গঠিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় নেতাদের সমন্বয়ে। ধর্মীয় অনুশাসন বা ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় এই কমিটি।
আর ধর্মীয় অনুশাসনে শুধু ‘শারীরিক অবস্থা’ বিবেচনায় এ অস্ত্রোপচারের অনুমতি মেলে। ‘মানসিক চাহিদা’ এ ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য হিসেবে ধরা হয় না।
অনুমতি দেয়া হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে আবেদনকারীর রক্ত ও হরমোন পরীক্ষা, আর ক্রোমোসোম বিশ্লেষণ করা হয়। একই সঙ্গে পরবর্তী দুই বছর তাকে মানসিক ও নানা রকম হরমোন চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এসব শর্ত পূরণ করতে না পেরে ট্রান্সজেন্ডার হতে চাওয়া অনেক মানুষই অস্ত্রোপচারের অনুমতি পান না।
মিসরে এ সংখ্যা কত, সে বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানও নেই।
অভিযোগ রয়েছে, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মতি ছাড়া কোনো অস্ত্রোপচার হয় না। অথচ কমিটির বৈঠকের কোনো নির্দিষ্ট দিন-তারিখ নেই। ইচ্ছেমতো বৈঠক হয়। দুই বছর ধরে কমিটির প্রধানের পদটিও খালি।
এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি আল-আজহার কর্তৃপক্ষ।
অস্ত্রোপচারের পরের লড়াই
লিঙ্গ নির্ধারণ অস্ত্রোপচারের অনুমতি পেতে যখন লড়ছিলেন, সে সময় চাকরিচ্যুত হন ১৩ বছরের স্কুলশিক্ষক ফরিদা।
এ নিয়ে ফরিদা বলেন, ‘আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। ২০১৬ সালে শেষ অস্ত্রোপচারের আগ পর্যন্ত ছোটখাটো কাজ করে টাকা জমিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।’
প্রায় ৩০ বছর ধরে সামাজিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছেন ট্রান্সজেন্ডার নারী ফরিদা রামাদান। ছবি: এএফপি
বর্তমানে কর্মহীন ফরিদা। গত ১৫ বছরে অসংখ্য ছোটখাটো কাজ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সব কাজ থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে তাকে।
ফরিদা জানান, প্রতিবেশীরাও তাকে এড়িয়ে চলে। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে গেলেও হয়রানির শিকার হন তিনি। প্রতিনিয়ত অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে হয় তাকে। যৌন হয়রানির ঘটনাও তার জীবনে অজস্র।
শারীরিক রূপান্তর নিয়ে ফরিদা বলেন, ‘যারা নারী থেকে পুরুষ হয়, তাদেরকে আমাদের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। তারা ট্রান্সজেন্ডার নারীদের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক স্বীকৃতি পায়।’
হাল ছাড়বেন না ফরিদা
চার বছর আগে উত্তরের বেহেরিয়া অঞ্চলের এক গ্রামে নিজের জন্য একটি বাড়ি পেয়েছেন ফরিদা। প্রতি মাসে গ্রামবাসী নিজেদের সঞ্চয় থেকে ফরিদাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন তার খেয়ে-পড়ে বাঁচা নিশ্চিতে।
ফরিদার প্রতিবেশী ওম মেন্না এএফপিকে বলেন, ‘আর সবার মতোই ফরিদাকেও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।’
প্রতিবেশীরা ফরিদাকে ‘ওম আলা’ বলে ডাকেন, যার অর্থ ‘আলার মা’। যখন ছোট ছিলেন আর মা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তখন ভবিষ্যতে সন্তান হলে তার নাম আলা রাখবেন বলেন ভেবেছিলেন ফরিদা। সেখান থেকেই এই ডাক।
ফরিদা বলেন, ‘গ্রামের সবাই আমাকে এই নামেই ডাকে। খুব ভালো লাগে আমার। আমাকে ভালোবাসে এমন কিছু মানুষ আমি পেয়েছি। কিন্তু এখনও সম্মান নিয়ে বাঁচতে আরও অনেকটা পথ যেতে হবে আমাকে।’
নিজের অধিকার আদায়ে মামলার পরিকল্পনা করছেন ফরিদা।
তিনি বলেন, ‘আমি কাজ করতে চাই। নিজের জীবিকা উপার্জন নিজেই করতে চাই। আমি চুপ করে বসে থাকব না। আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।’
ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি মিসরের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
গত বছরের মে মাসে মিসরের ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের পক্ষে প্রথম সোচ্চার হন দেশটির প্রবীণ অভিনয়শিল্পী হিশাম সেলিম।
এই শিল্পীর ছেলে নূর নারী থেকে পুরুষ হয়েছেন। এতে বাবা হিসেবে নিজের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান তিনি।
এ ঘটনায় কিছু ভক্ত-অনুসারীর সহানুভূতি পেলেও তুমুল বিতর্কও শুরু হয় তাকে ঘিরে।
২০১৭ সালে ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী সারাহ হেগাজি প্রকাশ্যে সমকামী ও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতীক হিসেবে রংধনু পতাকা ওড়ানোয় গ্রেপ্তার হন।
বন্দি অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পর কানাডায় আশ্রয় নেন। গত বছর তিনি আত্মহত্যা করলে বিশ্বজুড়ে আলোচনা শুরু হয়।
বেদায়া নামের সংগঠনের অধিকারকর্মী বলেন, “নূর আর ফরিদা কিছুটা জনসমর্থন পেয়েছেন। কারণ সমাজের একটি অংশ বিশ্বাস করে যে নূর, ফরিদার লিঙ্গ পরিবর্তন ‘ভুল সংশোধন’ ছিল। যেহেতু নানা পরীক্ষায় উৎরে তারা প্রশাসনের কাছ থেকে লিঙ্গ পরিবর্তনের অনুমতি পেয়েছেন।”
হেগাজির প্রতি জনসমর্থন জানানোর কারণে নূরের প্রতি জনসমর্থন মুহূর্তের ক্ষোভে পরিণত হয়। নানাভাবে আক্রমণের শিকার হন তিনি।
গত নভেম্বরে ফরিদা রামাদান টেলিভিশনে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেন। সেখানে তিনি আবারও শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের উপার্জিত অর্থে বাঁচতে চাই আমি, অন্যের সাহায্যে নয়। আমি অসুস্থ। নিজের চিকিৎসা নিজেই করাতে চাই। এ জন্য অন্তত আমার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার অধিকার ফিরে পেতে আমাকে সাহায্য করুন।’
সে সময় মিসরের শিক্ষামন্ত্রী তারেক শাওকি জনগণের প্রতি ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানান।
মিসর সরকারের কোনো প্রতিনিধির সরাসরি এ ধরনের আহ্বান সেটাই ছিল প্রথম।
মন্ত্রী সে সময় ফরিদাকে পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার আশ্বাস দিলেও তা পূরণ হয়নি।