করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ প্রতিরোধে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন চলছে সারা দেশে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জন। লকডাউনে বিভীষিকাময় অবস্থায় পড়েছে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীও।
এসব জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বলছেন, অনেকটা না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সহায়তা মেলেনি, এমনকি ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় ফুটপাতে খাবারের দোকান চালাতেন ট্রান্সজেন্ডার কণা। লকডাউনের শুরু থেকেই তার উপার্জন বন্ধ।
কণা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই দেশে হিজড়াদের কোনো অবস্থান নাই। আমাদের কেউ দেখার নাই, কেউ বলার মানুষও নাই। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের নিয়ে কাজ করে তারাও খোঁজ নিচ্ছে না।’
কড়াইল বস্তিতে থাকেন ট্রান্সজেন্ডার নসির। পেশায় একজন যৌনকর্মী। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা রাতে কাজ করি, এখন সে কাজ বন্ধ। রাস্তায় বের হলে পুলিশ আমাদের হয়রানি করে, অত্যাচার করে। কাস্টমার না পাওয়ায় আয় নেই। ঘরে কোনো খাবার নেই।’
কোথাও থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একে তো লকডাউন, তার উপর রমজান মাস। আমার ঘরেই কিছু নাই, তারপরেও অনেক হিজড়া এসে আমার কাছে সাহায্য চায়। তারা বলে, কোথাও কিছু পেলে তাদেরও যেন একটু দেই।’
ট্রান্সজেন্ডারদের অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারে কোনো সংগঠন পাশে দাঁড়ায়নি
ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করেন অ্যাক্টিভিস্ট জয়া সিকদার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, “এই বিপদে ট্রান্সজেন্ডারদের পাশে তাদের ‘গুরু মা’ও (গোষ্ঠী প্রধান) নেই। গুরু মা বলছে, তোমরা তোমাদের বাড়ি চলে যাও। এখন চাইলেই তো তারা বাড়ি যেতে পারে না।’
এই দুঃসময়ে ট্রান্সজেন্ডারদের পাশে সরকারের দাঁড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেন জয়া।
চল্লিশোর্ধ্ব মাহি কমলাপুর এলাকার ট্রান্সজেন্ডারদের গুরু মা। ৩০ জনের বেশি ট্রান্সজেন্ডার আছেন তার সঙ্গে, যাদের মধ্যে অসুস্থ ও পঞ্চাশোর্ধ ৩-৪ জন। মাহি নিজেও স্ট্রোকে ভোগা রোগী। প্রতিদিন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হলেও কেনার টাকা তাদের নেই।
মাহি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকজন বাড়ি চলে গেছে, আমরা ২০ জনের মতো আটকা পড়ে আছি। আমার কাছে যতটুকু ছিল ততটুকু দিয়ে চালাচ্ছি, কিন্তু আর পারছি না। কোনো সংগঠন বা সরকার থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য আসেনি।’
মাহি বলেন, ‘আমার নিজেরই প্রতিদিন ১৮০ টাকার ওষুধ লাগে। আমার মতো এমন তিন চারজন আছেন। এখন তো ঘর থেকেই বের হতে পারছি না, এত মানুষ আমরা কীভাবে চলব। বাসা ভাড়া কোথা থেকে দেব, তাও বুঝতে পারছি না।’
ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের কাছ টাকা সংগ্রহ করে জীবন চালান। তেমনই একজন দক্ষিণ কমলাপুরের তিশা।
তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে রাস্তাঘাটে বের হতে পারছি না। আমাদের তো সে রকম আয় রুজি নাই যে, এক-দুই মাস ঘরে বসে খাব। ঘরে যা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। বাসায় চাল নাই। চুলায় হাড়ি চড়ছে না, সবকিছুই শেষ।’
‘আমাদের খাওয়া, ঘরভাড়া সব কিছুর দিক দিয়ে বিপদে পড়ে গেছি। সরকারের কাছে আকুল আবেদন আমাদের সাহায্য করা হোক। দুবেলা ভাত খেয়ে যাতে টিকে থাকতে পারি, এর বেশি কিছু চাওয়ার নাই।’
ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট জয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউন শুরুর পর চার থেকে পাঁচ দিন কোনোমতে সবাই চলেছে। এরপর দ্বিতীয় দফা লকডাউনে ট্রান্সজেন্ডারদের সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। দুইদিন পর যখন বাসা ভাড়া দিতে পারবে না, বাড়িয়ালা তখন ওদের গলায় পাড়া দেবে, তখন তারা কী করবে!’
অভুক্ত ট্রান্সজেন্ডারদের খাদ্য সহায়তা দিতে ১৭১৮৫১২৫১২ নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ করেন জয়া।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারদের স্বতন্ত্র লিঙ্গ হিসেবে সাংবিধানিক এবং আইনি স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ ভোটাধিকারও পেয়েছেন তারা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি।