বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ দমিয়ে রাখতে পারেনি সনিকে

  •    
  • ১০ মার্চ, ২০২১ ২৩:৩২

তখন তার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। তিনি অন্তঃসত্ত্বা। যেকোনো সময় ডেলিভারি। সবাই তাকে থামতে বলেন। কিন্তু তিনি ইয়ার লস দিতে রাজি হননি। পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই থাকে। ১৫ অক্টোবর তার মেয়ে হয়। তিন দিনের বাচ্চা বাসায় রেখে আবার শেষ পরীক্ষা দিতে যান।      

পড়াশোনার প্রতি তার ছোটবেলা থেকেই প্রবল ঝোঁক। এ জন্য দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ আর পোশাক কারখানার কাজ কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে।

তিনি এখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্রী। পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করেন একটা বেসরকারি সংস্থায়। অদ্যম এই ছাত্রীর নাম সনি আক্তার। বাড়ি বগুড়ায়।

সনি তার জীবনযুদ্ধ জয়ের গল্প শোনান নিউজবাংলাকে। বলেন, ‘২০০৮ সালে গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ফ্যামিলিসহ (ছোট বোন, ভাই ও মা-বাবা) ঢাকায় আসছি। মূলত গ্রামে আমার ফ্যামিলি টাকা-পয়সার ক্রাইসিসে ছিল। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। এসেই আশুলিয়ার শ্রীপুরে ফিনিক্স টেক্সটাইলে চাকরি নিই। ইন্টারভিউ নেয় লাইন কিপার পদের জন্য। গ্রামের স্কুলে আমি ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। তাই ইন্টারভিউয়ে টিকে যাই। মূলত সবার হাজিরা কার্ড, এসব লেখার কাজ ছিল। বেতন ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরপর আমি একটা সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে স্যাম্পলম্যান হিসেবে কাজ করি। ওই ফ্যাক্টরিতে আমি ডিজাইন সেকশনে মার্চেন্ডাইজারদের সাথে কাজ। এক বছর কেটে গেলে ২০০৯ সালে আমি ওপেন ইউনিভার্সিটিতে (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে) ভর্তি হওয়ার কথা চিন্তা করলাম। আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নাইনে মানবিক শাখায় ভর্তি হই। এসবের মাঝে প্রেমে পড়ি আরেক কারখানার স্টাফ সাইফুল ইসলামের। ২০১০ সালে আমরা বিয়েও করি।’

তার সাফল্যের পেছনে স্বামী সাইফুল ইসলামের অবদানের কথা উল্লেখ করে সনি বলেন, ‘আমার হাসবেন্ড খুব হেল্পফুল। তার সাপোর্টেই আসলে আমি এতদূর এসেছি।’

চাকরি, লেখাপড়া আর সংসার- তিনটি কীভাবে একসঙ্গে সামলান জানতে চাইলে সনি বলেন, ‘ওই সময় আমার খুব কষ্ট হতো। কারখানায় সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার। আর ওই দিন ক্লাস করে এসে রাতে পড়াশোনা করতাম। মূলত আগের কারখানার চাকরি ছেড়ে তখন আমি ইপিজেডে সুইং সেকশনে কাজ নিই। ইপিজেডের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কাজ করছি। আসলে এটা আমার কাছে তখন মনে হতো, আমাকে ক্লাসে যেতে হবে। আমাকে পাস করতে হবে। বড় কিছু হতে হবে। এই জিনিসটা আমার মধ্যে কাজ করত। একটা জিনিস সব সময় মাথায় ছিল। আমি পড়াশোনা করব। সার্টিফিকেট নেব বা আমি আরও বড় কিছু করব। এ জন্য ক্লান্তিটা আমাকে দমায় রাখতে পারে নাই।’

সনি ২০১২ সালে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে পাস করেন। পরে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) এইচএসসিতে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন।

তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর আমার পেটে সন্তান আসে। চার মাসের মাথায় আমি চাকরি ছেড়ে দিই। এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। সেকেন্ড পরীক্ষাটায় আমি হসপিটালে শিফট ছিলাম। এই সময়টাতে আমাকে সবাই বলছিল থেমে যেতে। যেকোনো সময় পেইন উঠতে পারে। যেকোনো সময় ডেলিভারি। কিন্তু আমি ইয়ার লস দিতে চাইনি। তখন পরিবারের সবাই মিলে আমাকে গণস্বাস্থ্যের অ্যাম্বুলেন্সে সাভার কলেজে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যান। পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই থাকে। ১৫ অক্টোবর আমার মেয়ে হয়। তিন দিনের বাচ্চা বাসায় রেখেই আবারও শেষ পরীক্ষা দিতে যাই। আমি পাস করি।’

সনি আরও বলেন, ‘আমার বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে কখনও বাসায় বসে থাকতাম না। দুই বেলা ২০ জন স্টুডেন্ট পড়াইতাম। টিউশনি করে মাসে সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পেতাম।’

২০১৭ সালে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। প্রথম সেমিস্টারে শুধু সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাস পেয়েই প্রতিটা সেমিস্টার পাস করছেন। কয়েক মাস পরেই স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল শেষ হবে।

২০১৯ সালে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার স্বামীর চাকরি চলে যায়। এমন একটা অবস্থায় সনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না পড়াশোনা ছেড়ে আবার চাকরির চেষ্টা করবেন কি না। পরে তার স্বামীর এক পরিচিতজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘে চাকরি পান।

সনি বলেন, ‘আমি সোশ্যাল ওয়ার্কার পদে জয়েন করি কালিয়াকৈর জোনে। নারীরা যাতে বিদেশে কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে জেনে-বুঝে যান, এসব নিয়ে কাজ করছি। মূলত নারীর ক্ষমতায়তন।’

এখানেই থামতে চান না সনি। তিনি স্বপ্ন দেখেন। বলেন, ‘আমার লাস্ট পরিচয়টা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কিংবা এনজিও কর্মী না। আমি এটাতেই থেমে থাকতে চাই না। আমি বিসিএস ক্যাডার হতে চাই। এসপি হওয়ার স্বপ্ন দেখি।’

স্বামী সাইফুল ইসলামও গার্মেন্টের চাকরি ছেড়ে এখন ছোটখাটো ব্যবসা করছেন। আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ কাঁঠালবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। অদম্য এই নারীর জীবন কাটছে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই।

সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, পড়াশোনার প্রতি তার স্ত্রীর আকর্ষণটা অনেক বেশি। তাই তো চাকরি, সংসার সব কিছু সামলে লেখাপাড়াটা চালিয়ে গেছেন। ওই সময়টায় অনেক কষ্ট হলেও এখন তাদের দাম্পত্য জীবন অনেক সুখের।

তিনি বলেন, ‘সনির জন্য এখন আমি পরিচিতজনদের কাছে গর্ববোধ করি।’

নারী প্রগতি সংঘের ট্রেইনার কাম কো-অর্ডিনেটর খাইরুল মামুন মিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই প্রজেক্টটা পরিচালিত হয় আইএলওর তত্ত্বাবধানে। এটা তার (সনি) জীবনের জন্য একটা বড় সাফল্য বলে আমি মনে করি। আমার ধারণা ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের মধ্যে হয়তো দুই-একজন এই জায়গায় আসতে পারছেন।’

সনি আক্তার বর্তমানে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় নারী প্রগতি সংঘ নামে একটি এনজিওর মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত। এই এনজিও’র আওতায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) প্রজেক্টে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

এ বিভাগের আরো খবর