বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঘরের কাজে হাত লাগাচ্ছে পুরুষেরাও

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২১ ০৮:২৯

২০১৭ সালে যেখানে নারী ও পুরুষের গৃহস্থালির কাজে সময় ব্যয়ের ব্যবধান ছিল ৫ দশমিক ১৯ ঘণ্টা, ২০১৮ সালে এই ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭৫ ঘণ্টায়। ২০১৯ সালে এ ব্যবধান ৩ দশমিক ৪৩ ঘণ্টায় নেমে এসেছে।

পুরুষের শ্রম মানে সংসারের আয়। বিনিময়মূল্য বা মজুরি ছাড়া কোনো পুরুষ শ্রম দেয় এমনটা এত দিন চিন্তাই করা যায়নি। বিপরীতে গৃহস্থালির কাজের দায় কেবল নারীর, যার কোনো পারিশ্রমিক নেই। এ থেকে আয় আসে না। সংসারের যাবতীয় কাজ নারীরাই করে যাবেন।

এই ছিল চিরকালীন মানসিকতা।

কিন্তু সময় বদলেছে। পুরুষের এই মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। এখন পুরুষেরাও বাড়ির কাজে নারীর মতো বিনা মজুরির শ্রম দিচ্ছেন। পরিমাণ বিচারে তা অনেক কম হলেও পারিবারিকভাবে এ চর্চা এখন শুরু হয়েছে।

কিশোর, তরুণ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহরাঞ্চল বা গ্রামে পুরুষের মধ্যে ঘরের কাজে অংশ নেয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে।

বাসাবাড়ি বা গৃহস্থালির কাজের তালিকায় রয়েছে রান্না করা, সন্তান লালনপালন এবং স্কুলে আনা-নেয়া, কাপড় পরিষ্কার, ঘর ধোয়ামোছা, বিছানা ঝাড়া, মশারি টাঙানো, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সেবা করার মতো বিষয়গুলো।

ঐতিহ্যগতভাবে সেবামূলক এসব কাজে নারীর অবদান একচ্ছত্র। যুগ যুগ ধরে তারাই মূলত পরিবারের সদস্যদের ভালোবেসে কোনো অর্থমূল্য ছাড়া এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সেবামূলক এই কাজগুলোকে পুরুষেরা এত দিন নারীর দায়িত্ব ভেবে এড়িয়ে চলতেন। খুব একটা মূল্যায়নও করতেন না। এখন সচেতন পুরুষেরা এসব সেবামূলক কাজের জন্য নারীর কষ্ট ও ত্যাগকে অনুধাবন করতে শুরু করেছেন। কিছুটা হলেও ভার তুলে নিচ্ছেন নিজেদের কাঁধে।

অনেকেই এখন বাইরের কাজে ব্যস্ততা সেরে ঘরে ফিরে সহায়তা দিচ্ছেন স্ত্রীকে, কেউ মা কিংবা বোনকে। সবকিছু দেখছেন ভালোবাসার দৃষ্টিতে। বয়সের পার্থক্য এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ফলে অনেকেই কর্মস্থল থেকে ঘরে ফিরে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাসাবাড়ির জমে থাকা অনেক কাজ সারছেন নিজ হাতে।

গৃহস্থালির কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ও জরিপে।

এ বিষয়ে অ্যাকশনএইড পরিচালিত জরিপে নারীর কাজে পুরুষের সহায়তা প্রদানের প্রবণতা বাড়ার সুস্পষ্ট তথ্য উঠে এসেছে।

অ্যাকশনএইডের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে নারীরা মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজ করেছেন দৈনিক ৭ দশমিক ৭৮ ঘণ্টা। পুরুষেরা করেছেন ১ দশমিক ১ ঘণ্টা। ২০১৭ সালে একই কাজে নারীর সেই অবদান কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৫০ ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। আর পুরুষের অবদান বেড়ে ২ দশমিক ৩৭ ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে।

অর্থাৎ গৃহস্থালির অবৈতনিক কাজে নারী-পুরুষের সময় ব্যয়ের ব্যবধান প্রতিবছর কমে আসছে। অর্থাৎ পুরুষেরা এ কাজে নিজেদের সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন।

২০১৭ সালে যেখানে নারী ও পুরুষের গৃহস্থালির কাজে সময় ব্যয়ের ব্যবধান ছিল ৫ দশমিক ১৯ ঘণ্টা, ২০১৮ সালে এই ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭৫ ঘণ্টায়। ২০১৯ সালে এ ব্যবধান ৩ দশমিক ৪৩ ঘণ্টায় নেমে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা জরিপে দেখেছি, গৃহস্থালির অবৈতনিক সেবামূলক কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বাড়ছে। তারা এ কাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখন ঘরের সেবামূলক কাজকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করতে শিখেছেন এবং এর পাশাপাশি নারীকেও সহযোগিতা দিচ্ছেন।’

এটি শুধু যে শহুরে পরিসরে ঘটছে তা নয়। রাজধানীর বাইরে জেলা বা থানা পর্যায়েও গৃহকাজে বাড়ছে পুরুষের অংশগ্রহণ।

তিনি বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও লালমনিরহাটে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে নারীদের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন পুরুষেরাও। স্বামী গৃহস্থালি কাজের ভাগ নেয়ায় নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য কাজের সময় পাচ্ছেন।

গৃহস্থালির সেবামূলক মজুরিবিহীন কাজে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণা করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তার গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে, ভোর শুরু হওয়ার পর আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একজন নারী কীভাবে অবৈতনিক সেবামূলক কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে থাকেন। এ কাজ অবৈতনিক হওয়ায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তাদের শ্রম ও কর্মঘণ্টা হিসাব হচ্ছে না।

গৃহস্থালির কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এ সম্পর্কে ড. ফাহমিদা খাতুনের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ঠিক, পুরুষের মানসিকতায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে সবার মধ্যে আসেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখনও আগের মানসিকতাই পোষণ করছেন। তারা এ সেবামূলক কাজগুলোকে এখনও নারীর দায়িত্ব ভেবে সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলছেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে ড. ফাহমিদা বলেন, গৃহস্থালির সেবামূলক ও মজুরিবিহীন কাজে পুরুষ ভিড়তে শুরু করেছে, এটা ইতিবাচক দিক। তবে শতকরা কত ভাগ বেড়েছে, প্রকৃত তথ্য পেতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।

‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ এমন স্লোগানে নারীর অমূল্যায়িত কাজের স্বীকৃতির দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। কতটা অগ্রগতি হলো এ লড়াইয়ে, এমন প্রশ্ন রাখা হলে বেসরকারি এ সংস্থাটির কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলি, তাহলে বলব অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। পুরুষের মানসিকতার বড় পরিবর্তন ঘটেছে। একটা সময় বাপ-দাদারা পানিটুকুও ঢেলে খেতেন না। এখন পানি ঢেলে খাচ্ছেন, এমন মানুষ বহু মিলবে। এটা একটা উদাহরণ। নারীর কষ্ট লাঘব হয়, এমন অন্যান্য কাজেও পুরুষেরা এখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।’

তবে তথ্য-উপাত্তের দিক থেকে সেটি এখনও খুব বেশি নয় বলে মনে করেন শাহানা হুদা। তিনি বলেন, ‘কারণ এখনও নারী প্রতিদিন গড়ে ১২টির বেশি মজুরিবিহীন কাজ করছেন, পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৭টি।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ মতে, ১৯৮৩-৮৪ সালে বেতনভুক্ত কাজে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৭ দশমিক ৮ ভাগ এবং পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল ৮৯ দশমিক ৯ ভাগ। ২০১০ সালের হিসাবে এতে নারীর অবদান বেড়ে ৩৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বেতনভুক্ত কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে অবৈতনিক কাজ হ্রাস পায়। অবৈতনিক কাজ সাধারণত গৃহস্থালিতেই হয়ে থাকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বাড়ছে। ফলে বেতনভুক্ত কাজেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প, সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছে। এর মধ্যে ৫৯ লাখ ৩ হাজার নারী অর্থের বিনিময়ে উৎপাদনশীল বিভিন্ন খাতে কাজ করছে। বাকিরা অনুৎপাদনশীল খাতে মজুরির বিনিময়ে কাজ করছে।

শাহানা হুদা বলেন, ‘গৃহকাজে নারী-পুরুষ সমতায় না এলেও অন্তত সমতার কাছাকাছি পরিবর্তন আমরা দেখতে চাই। যদিও এর জন্য আরও সময় লাগবে। আগামী প্রজন্ম হয়তো এটা দেখতে পাবে। সে আশাতেই আমরা কাজ করছি। সরকারও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। সে ক্ষেত্রে দরকার সমাজ সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং জেন্ডার সহায়ক বাজেট বৃদ্ধি করে এ-সম্পর্কিত প্রকল্প চালু করা।’

এ বিভাগের আরো খবর