নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) হতে পারবে না- হাইকোর্টের এই রায়ে সংক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারী আয়েশা সিদ্দিকা।
বুধবার নিউজবাংলাকে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নারীর বিরুদ্ধে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না বলে আইন মন্ত্রণালয় আমাদের বাতিল করেছে। এরপর হাইকোর্টও সেটি বহাল রেখে রায় দিয়েছে। এতে আমি সংক্ষুব্ধ। নারীদের জন্য আমি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে লড়াই করে যাব। আশা করি, সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’
আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘নারীদের মধ্যে যারা আলিম, ফাজিল পাশ করে ঘরে বসে থাকেন, তাদের জন্য আমার এই লড়াই চলবে।’
তার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ জানিয়েছেন, চূড়ান্ত আপিল করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এজন্য সার্টিফাইয়েড কপিও সংগ্রহ করেছেন। আগামী ১০ দিনের মধ্যে আপিল করবেন।
সামাজিক ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) হতে পারবে না মর্মে আইন মন্ত্রণালয়ের সিন্ধান্ত বহাল রেখে গত বছর রায় দেয় হাইকোর্ট। গত ৯ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
বিষয়টি নিয়ে রিটকারী আয়েশা সিদ্দিকার কাছে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কারণ উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, আমি মনে করি না এসব কারণ কোনো নারীর জন্য নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে বাধা হতে পারে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না, এমনটি উল্লেখ ছিল না।
‘তাছাড়া নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ হলো নিকাহ রেজিস্ট্রি করা। কিন্তু বিয়ে পড়ানোর কাজ তো সংশ্লিষ্ট এলাকার মসজিদের ইমাম বা আলেমদের। এক জন নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব তো বিয়ে পড়ানো নয়। আমি চাকরি নিতে চাচ্ছি রেজিস্ট্রি করার জন্য। নারীদের ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি দেখানো হয়েছে, আমার মনে হয় না এতে কোনো বাধা হতে পারে।’
রাত-বিরাতে কাজের জন্য বাইরে যেতে নারীদের জন্য বাধা হতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে নিকাহ রেজিস্ট্রি করার জন্য তো একটা অফিস আছে। সেখানেই তো নিকাহ রেজিস্ট্রি হবে। বিয়ে পড়ানোর পরেও রেজিস্ট্রি করানো যায়। আগে বিয়ে হয়, পরে রেজিস্ট্রি।
‘আর রাত-বিরাতের যে বিষয়টি বলা হয়েছে, তাহলে আমি বলব আমাদের পুলিশ বাহিনীতে নারীরা কাজ করছেন। তারা কি রাত-বিরাতের কাজ করছেন না? ডাক্তার, নার্স আছেন। তারা কি রাতে কাজ করছেন না? তাদের ক্ষেত্রে তো বাধা নেই। তাহলে কি শুধুমাত্র নিকাহ রেজিস্ট্রারের ক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে সমস্যা?’
মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেছেন জানিয়ে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ২০১২ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। সেই সার্কুলারে নারীদের জন্য কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। সেটা দেখেই তিনি আবেদন করেন।
২০১৪ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজি) হিসেবে তিন জন নারীর নাম প্রস্তাব করে উপদেষ্টা কমিটি।
এরপর ২০১৪ সালের ১৬ জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ মর্মে চিঠি দিয়ে তিন সদস্যের প্যানেল বাতিল করে।
পরে আইন মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন নিকাহ রেজিস্ট্রারের প্যানেলের এক নম্বর ক্রমিকে থাকা আয়েশা সিদ্দিকা। সেই রিটের শুনানি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রুল খারিজ করে রায় দেয় হাই কোর্ট। তাতে আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই বহাল রাখা হয়। শনিবার প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়।
আদালতে রিটকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মো. হুমায়ুন কবির।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশন থাকেন। মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান হয় মসজিদে।
‘ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারে না এবং তারা নামাযও পড়তে পারে না। সুতারাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে আদালত রুল খারিজ করে দিয়েছে। এর ফলে নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না।’
রিটকারী আয়েশা সিদ্দিকার নতুন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। নারীরা বিমানের পাইলট হচ্ছেন। সশস্ত্র বাহিনীতে নারীরা কাজ করছেন। তাহলে কেন নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না?’
ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরই সিএমপি ফাইল করা আছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আমরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেয়েছি। সব প্রস্তুত করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত আপিল করব।’