নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ ও নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রদূত ও সাহিত্যিক বেগম রোকেয়ার জন্মদিন ও প্রয়াণ দিবস আজ ৯ ডিসেম্বর।
সমাজসংস্কারে বেগম রোকেয়ার অবদানকে স্মরণ করে আজকের দিনটিকে ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম।
বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন।
তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার নানা কুসংস্কার, কুপ্রথা অতিক্রম করে নারীর শিক্ষা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইটা ছিল অনেক কঠিন।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও তার ভাইদের সহযোগীতায় তিনি বাড়িতেই পড়ালেখা করার সুযোগ পান।
১৮৯৮ সালে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় সমাজসচেতন ও প্রগতিশীল দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। বিয়ের পরে তার নাম হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার স্বামী সাখাওয়াৎ হোসেনের অনুপ্রেরণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯০৯ সালে সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন।
স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থে পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালে ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ চালু করেন।
কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ১৯১১ সালে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে আবারও তিনি নতুন করে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণসহ নানা কারণে অনেকবার স্কুলটির স্থান বদল করতে হয়েছে।
প্রায় দুই যুগ ধরে বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সে সময়ে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষা লাভের পীঠস্থানে পরিণত করেন স্কুলটিকে।
স্কুলটিতে মেয়েদের পাঠানোর জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের অনুরোধ করতেন তিনি।
প্রথমদিকে কেবল অবাঙালি ছাত্রীরাই পড়ত স্কুলটিতে। বেগম রোকেয়ার অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে বাঙালি মেয়েরাও এগিয়ে আসে পড়ার জন্য।
সাহিত্যিক হিসেবে বেগম রোকেয়া ছিলেন সে সময়ের সাহসী অগ্রদূত ও এক অনন্য প্রতিভা। তার সমগ্র সাহিত্যকর্মে তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে ও নারীশিক্ষা, নারী অধিকার ও নারী জাগরণের পক্ষে তার অবস্থানের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে ।
সেই সময়ের খ্যাতনামা- নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন।
বেঁচে থাকতে বেগম রোকেয়ার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়। এগুলো হচ্ছে দুই খণ্ডে বিভক্ত প্রবন্ধ সংকলন- ‘মতিচূর’, উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধ-বাসিনী’, ‘কাহিনি-কণিকা’ এবং একমাত্র ইংরেজি বই ‘Sultana’s Dream’।
এ ছাড়া অসংখ্য প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক রচনা ও অনুবাদ রয়েছে তার।
সে সময়ে অভিজাত শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি রোকেয়ার ছিল গভীর মমত্ববোধ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এ দেশের অধিকাংশ মুসলমানের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষাকেই তিনি তার মত প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা মনে করতেন।
১৯২৭ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বেগম রোকেয়া। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের দাবিও তুলে ধরেন তিনি।
বাংলাদেশে নারী মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে বেগম রোকেয়ার অবদান চির অম্লান।
বেগম রোকেয়ার জীবনকাল ছিল মাত্র ৫২ বছর। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয়।