নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার ১৪ বছর বয়সী মারুফাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় চলতি বছরের ৯ মে। এ ঘটনায় মামলা হয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহ মাহবুব মোর্শেদ কাঞ্চনের বিরুদ্ধে।
আলোচিত ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। তবে দুই দিন পরেই জামিন পান চেয়ারম্যান মোর্শেদ। গতি হারিয়ে থমকে আছে মামলার তদন্তও।
মারুফার মা মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এসেছিলেন মেয়ের হত্যার বিচার চাইতে। সংবাদ সম্মেলনে তার সঙ্গে ছিলেন নির্যাতনের শিকার আরও তিন নারী ও শিশুর পরিবারের সদস্যরা।
বেসরকারি সংগঠন ‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট’ আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই জোরালো হলেও কিছুদিনের মধ্যে তা আড়ালে চলে যায়। ফলে বিচারবঞ্চিত হয় ভিকটিমের পরিবার।
ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয় ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জে চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় জাকিয়া সুলতানা রুপাকে। ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকার আদাবরে ধর্ষণের শিকার হয় ১৪ বছরের গৃহকর্মী কাকলী। আর এ বছরের ৯ মে নেত্রকোণায় ধর্ষণের পর ১৪ বছরের কিশোরী মারুফাকে হত্যা করা হয়।
এই চার জনের পরিবারই এখনো ঘটনার চূড়ান্ত বিচার পায়নি। কারো কারো ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা আটকে আছে দীর্ঘসূত্রতায়। কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হুমকি দিচ্ছে ভিকটিমের পরিবারকে।
ধর্ষণ এবং হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে প্রশাসন, পুলিশসহ সমাজে নিগ্রহের শিকার হওয়ার অভিযোগও করেন ভুক্তভোগীরা।
আমরাই পারি’র নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে কেবল একটি সংখ্যা এবং পরিবারের ব্যক্তিগত সমস্যা হয়ে যায়। রাষ্ট্র, মিডিয়া বা কোনো সংগঠনই ঘটনাগুলোর ফলোআপে মনোযোগী হয় না।’
প্রেসক্লাবে আসা চার জনের পরিবারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই নামগুলো কিছুটা পরিচিত বলে আমরা হয়ত একটু মনে রেখেছি। কিন্তু এমন হাজার হাজার হাজার ঘটনা আছে যেগুলো আমরা জানতেও পারি না। দেশে আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগের অভাবে আসামিরা বীরদর্পে সমাজে অবস্থান করে।‘
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর এই নয় মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী, যার মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২০৮টি। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া, ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ২০০ নারী, যৌন হয়রানি করা হয়েছে ১৬১ জন নারীকে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, আত্মহত্যা করেছে ১০ জন। যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত নয় মাসে শিশু নির্যাতন ও হত্যার চিত্র আরো উদ্বেগজনক। এ সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২৭ শিশু আর ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ২০টি। হত্যা করা হয়েছে ৪৪৫ শিশুকে।
পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ জন নারী। এদের মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ২৭৯ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ জন নারী। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬৮ জন নারী।
নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে নয়টি দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। এগুলো হলো- নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যেই শেষ করা; উচ্চ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা; বিচার চলার সময় নির্যাতনের শিকার নারী, শিশু ও পরিবারের নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার প্রক্রিয়া যুগোপযোগী করা।
দাবিগুলোর মধ্যে আরও আছে, হাইকোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া; পারিবারিক নির্যাতন সুরক্ষা আইন ২০১০ কার্যকর করা; ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা; নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা এবং সব ধরনের বৈষম্য মূলক আইন ও নারী নির্যাতনবিরোধী আইন সংশোধন করা।