প্রাথমিক স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্নপত্র লিখবেন, আর শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে আনা সাদা কাগজে এই প্রশ্নের উত্তর লিখে জমা দেবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এমন একটি ‘নির্দেশনা’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দাবি, এ ধরনের কোন নির্দেশনা তারা দেয়নি।
ছড়িয়ে পড়া নির্দেশনাটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড মিনিটরিং বিভাগের পরিচালক মনীষ চাকমার বরাতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেখানে তার কোন স্বাক্ষর নেই। নথিটিতে কোনো তারিখ বা স্মারক নম্বরও নেই। তবে এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি পত্রের স্মারক নম্বর ও তারিখ উল্লেখ রয়েছে।
নির্দেশনায় উল্লিখিত ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বরের ওই দুটি স্মারক নম্বরের নথি পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নির্দেশনাটির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দুটি নথির নির্দেশনার কোনো মিল নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত ৩১ অক্টোবরের নথিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি কীভাবে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত রূপরেখা দেয়া হয়। সেখানে বাড়ি থেকে শিক্ষার্থীর খাতা নিয়ে আসা বা বোর্ডে প্রশ্নপত্র লেখার মতো কোনো নির্দেশনা নেই।
এছাড়া ১ নভেম্বরের নথিতে আগের দিনের (৩১ অক্টোবর) নির্দেশনা ও শিক্ষার্থীর শিখন অগ্রগতির প্রতিবেদন-২০২২ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
এই দুই তারিখের নথিতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও স্মারক নম্বর রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বরের নথি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের দাবি, ভুয়া নথির ভিত্তিতে কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এই ভুয়া নথি ছড়ানোয় জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চলছে।
শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে খাতা আনা ও বোর্ডে প্রশ্ন লেখার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
২১ নভেম্বরের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি’ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে সে ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, অধিদপ্তর জানায়, এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে কোনো নিদের্শনা দেয়া হয়নি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে, প্রাথমিক পর্যায়ের কোমলমতি শিশুদের সম্পর্কিত স্পর্শকাতর বিষয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।’
একই দিন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সই করা বিজ্ঞপ্তিতেও একই তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, “সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি’ বিষয়ে স্বাক্ষরবিহীন একটি পত্র সামাজিক যোগাযোগ ও বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হচ্ছে যা অনভিপ্রেত ও অসত্য। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এখনো পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। উপযুক্ত সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হবে। এ অবস্থায়, উপযুক্ত বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো।”
কয়েকটি সংবাদমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, কয়েকটি উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা আলোচিত নির্দেশনাগুলো পেয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব কর্মকর্তা কীভাবে সেটি পেয়েছেন আমাদের জানা নেই। কারণ অফিসিয়ালি আমরা এমন কিছু কোথাও পাঠাইনি। সেখানে কোনো সিগনেচার নেই। কোনো স্মারক নম্বর নেই।
‘ওনারা যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পেয়ে এটা বলেন, তাহলে বলতে পারেন। কী কারণে বলেছেন আমরা সেটি দেখছি।’
কী ছিল কথিত সেই নির্দেশনায়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিজ্ঞপ্তিতে নয়টি নির্দেশনার উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হলো:
১. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় প্রান্তিকে বা চূড়ান্ত বার্ষিক মূল্যায়ন ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
২. তৃতীয় প্রান্তিকে প্রতি শ্রেণিতে প্রতি বিষয়ে সর্বোচ্চ ৬০ নম্বরের মধ্যে বার্ষিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে হবে।
৩ বিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে এই মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে হবে।
৪. প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগমূলক ও শিক্ষণক্ষেত্র বিবেচনায় নিতে হবে।
৫. মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণের নিকট থেকে কোনো মূল্যায়ন ফি গ্রহণ করা যাবে না।
৬. বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বোর্ড-এ প্রশ্নপত্র লিখে মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কোনো শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হলে সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে ফটোকপি করা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র ফটোকপির প্রয়োজন হলে বিদ্যালয়ের আনুসাঙ্গিক খাত থেকে ব্যয় করা যাবে।
৭. কোনো অবস্থাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন গ্রহণ করা যাবে না।
৮. চূড়ান্ত মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক সাদা কাগজ বাড়ী থেকে নিয়ে আসার জন্য পূর্বেই শিক্ষাথীকে অবহিত করতে হবে।
৯. প্রত্যেকটি বিষয়ে শ্রেণিপরীক্ষাসমূহের প্রাপ্ত নম্বর এবং চূড়ান্ত প্রান্তিকের প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রণয়ন করতে হবে।
এসব নির্দেশনা ছড়িয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড মিনিটরিং বিভাগের পরিচালক মনীষ চাকমার বরাতে। তবে মনীষ চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অসৎ উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরবিহীন বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতির চিঠি ছড়ানো হয়েছে। এটি অসত্য ও বানোয়াট।’