নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে জাতীয় দলের নারী ফুটবলারদের ‘বেতনবৈষম্য’ নিয়ে। একটি জাতীয় দৈনিকে দুই বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের ইনফোগ্রাফ নতুন করে ফেসবুকে পোস্ট করে অনেকে দাবি করছেন, জাতীয় দলের পুরুষ ফুটবলারদের তুলনায় অনেক কম বেতন পান নারীরা।
‘নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতনবৈষম্য’ শিরোনামের ওই ইনফোগ্রাফে নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ফুটবলারদের আয়ের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত নারী ফুটবলারদের মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা, ‘বি’ শ্রেণিভুক্তদের আট হাজার টাকা এবং ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত নারী ফুটবলাররা বেতন পান ছয় হাজার টাকা।
এতে পুরুষ ফুটবলারদের বেতনের তথ্য অবশ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়, ক্লাব পর্যায়ে শীর্ষ পর্যায়ের একজন ছেলে ফুটবলারদের বার্ষিক আয় ৫০-৬০ লাখ টাকা, আর নারী ফুটবলার সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকা আয় করেন।
এই ইনফোগ্রাফটি শেয়ার করে অনেকেই জাতীয় দলের নারী ফুটবলারদের ব্যাপক বেতনবৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলছেন।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বেতন কাঠামোর আওতায় কেবল নারী ফুটবলাররাই আছেন, অর্থাৎ নারী খেলোয়াড়েরাই কেবল বাফুফে থেকে প্রতি মাসে বেতন পান। জাতীয় দলের পুরুষ খেলোয়াড়দের বাফুফে কোনো বেতন দিচ্ছে না। তবে ক্লাব ফুটবলে নারীদের তুলনায় অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান পুরুষ খেলোয়াড়েরা।
দেশের নারী ফুটবলাররা ২০১৯ সাল থেকে বাফুফের বেতন কাঠামোর আওতাভুক্ত। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাবিনা-কৃষ্ণা-মারিয়াসহ ৩৬ ফুটবলারকে বেতনের আওতায় নিয়ে আসে সংস্থাটি। নারী খেলোয়াড়দের এই বেতন খুব বেশি না হলেও জাতীয় দলের পুরুষ খেলোয়াড়েরা এখন পর্যন্ত কোনো বেতন কাঠামোর আওতায় আসেননি।
জাতীয় দলে খেলার জন্য জামাল ভূঁইয়াদের কোনো বেতন দেয়া হয় না। ক্যাম্পে থাকাকালীন নামমাত্র খরচ আর ম্যাচ ফি পেয়ে থাকেন তারা।
পুরুষ ফুটবলারদের আয়ের একমাত্র উৎস ক্লাব ফুটবল। ক্লাবের চুক্তি অনুসারে তারা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন।
গত বছরের গত জুনে পুরুষ ফুটবলারদের বেতন কাঠামোয় আনার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এ কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেরা আপাতত বেতন কাঠামোতে নেই। ফান্ড পেলে মেয়েদের পাশাপাশি তাদের জন্যও কাঠামো করা হবে।’
জাতীয় পুরুষ দলের মতো নারী দলের জন্যও রয়েছে তহবিলের সমস্যা। এ কারণে নারী ফুটবলারদের বেতন বাড়ানো যাচ্ছে না বলে দাবি কছেন বাফুফে কর্তারা। বাফুফে ভবনে মঙ্গলবার এক সংবাদসম্মেলনে সংস্থার সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন জানান, সাফজয়ী নারী দলের সদস্যদের বেতন তিনি বাড়াতে চান, কিন্তু বর্তমানে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘আমি তো চাই বাড়াতে, কিন্তু পারছি না। যদি ফান্ড আনতে পারি তাহলে তো অবশ্যই দেব। ফান্ড এলে সেটা মেয়েদের ভাগেই যাবে।’
নারী খেলোয়াড়রা বাফুফের বেতনভুক্ত হলেও ক্লাবে পর্যায়ে অনেক কম পারিশ্রমিক পান সাবিনা-কৃষ্ণারা। সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকা, যেখানে তপু-জামালরা অর্ধকোটির উপরে আয় করেন।
বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেই নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের আয়ে তীব্র বৈষম্য রয়েছে।
ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবলের মতো জনপ্রিয় বৈশ্বিক খেলাগুলোতে পুরুষ অ্যাথলিটরা নারীদের চেয়ে অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান। এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে অধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের।
দেশে ফুটবলে জাতীয় দলের নারীরা বেতন পেলেও ক্রিকেটে বৈষম্যের চিত্র পরিষ্কার।
২০১৭ সালের সবশেষ বেতন কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা এ-প্লাস শ্রেণির পুরুষ ক্রিকেটাররা প্রতি মাসে বিসিবি থেকে বেতন পাচ্ছেন চার লাখ টাকা করে। এ-শ্রেণির ক্রিকেটাররা পান তিন লাখ টাকা। বি-শ্রেণির ক্রিকেটাররা দুই লাখ টাকা। সি-শ্রেণিতে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ডি-শ্রেণির ক্রিকেটাররা পান মাসে এক লাখ টাকা করে।
গত বছর জুনে সাকিব-তামিমদের মূল বেতন ১০-১২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।
নারী ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রেও একই হারে বেতন বাড়িয়েছে বোর্ড। তবে বৈষম্যের মাত্রা নারী ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে ভয়াবহ।
২০ শতাংশ বেতন বাড়ার পরেও এ-ক্যাটাগরিতে নারী ক্রিকেটারদের মাসিক বেতন এখন ৬০ হাজার টাকা। বি-ক্যাটাগরিতে ৪০ হাজার। সি-ক্যাটাগরিতে ৩০ ও ডি-ক্যাটাগরিতে ২০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন সালমা-জাহানারারা।
নারী ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। আগে ওয়ানডেতে ম্যাচ ফি ছিল ১০০ ডলার ও টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচ ফি ছিল ৭৫ ডলার। এখন ওয়ানডেতে ম্যাচ ফি করা হয়েছে ৩০০ ডলার ও টি-টোয়েন্টিতে করা হয়েছে ১৫০ ডলার।
ক্রিকেটের অন্যতম দুই পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেও রয়েছে একই ধরনের বৈষম্য।
সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার একজন চুক্তিবদ্ধ পুরুষ ক্রিকেটার বছরে দুই লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলার আয় করেন। নারীদের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক মাত্র ৬৫ হাজার ডলার।
গড়পড়তা বছরে আড়াই থেকে তিন লাখ পাউন্ড আয় করেন জাতীয় দলের একজন পুরুষ ক্রিকেটার।
নারীদের ক্ষেত্রে এ অঙ্কটা অনেক কম। ইংল্যান্ডের হিদার নাইট ও ট্যামি বিউমন্টের মতো সেরা তারকাদের বছরে বেতন এক লাখ পাউন্ড।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানেও রয়েছে তীব্র লিঙ্গ বৈষম্য। ভারতে ভিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মাদের মতো তারকাদের বাৎসরিক বেতন ৭ কোটি রুপি।
আর ভারতীয় নারী দলের অধিনায়ক হারমানপ্রিত কউর ও তারকা খেলোয়াড় স্মৃতি মান্ধানা বোর্ড থেকে বেতন পান বছরে ৫০ লাখ রুপি।
আরেক পরাশক্তি পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পান পুরুষ দলের অধিনায়ক বাবর আজম। তার বেতন বছরে ১ কোটি ৩২ লাখ পাকিস্তানি রুপি।
সেখানে নিদা দার ও সানা মিরের মতো পাকিস্তানের সেরা নারী ক্রিকেটাররা বেতন পান মাসে ১ লাখ ২০ হাজার পাকিস্তানি রুপি বা প্রায় ৫৮ হাজার টাকা।
চুক্তিবদ্ধ নারী ও পুরুষ ক্রিকেটাররা বেতনের বাইরেও টুর্নামেন্ট চলাকালীন ম্যাচ ফি, প্রতিদিন ভাতা পেয়ে থাকেন। এটি নির্ধারিত হয় সিরিজ ও ফরম্যাট অনুযায়ী।
এর বাইরে ব্যক্তিগত স্পন্সরশিপ, মিডিয়া বিজ্ঞাপনে কাজ করার অর্থও যোগ হয় ক্রিকেটারদের আয়ের সঙ্গে। তবে এসব ক্ষেত্রেও নারীর চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে পুরুষ খেলোয়াড়েরা।