জোর করে টিপসই নেয়া হচ্ছে। আর টিপসই দিতে না চেয়ে চিৎকার করছেন এক অসুস্থ ও বয়স্ক নারী। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
ভিডিওটির বরাতে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এসব খবরে বলা হয়েছে, জোর করে দলিলে টিপসই নিয়ে বোনের জমি দখল করে নিচ্ছেন তার ভাই রইস উদ্দিন।
ভিডিওতে দেখা যায়, ষাটোর্ধ্ব ও অসুস্থ ওই নারী শুয়ে আছেন একটি ভ্যানে। টিপসই নেয়া রইস উদ্দিনের পাশে ছিলেন স্থানীয় দলিল লেখক ও আরও কয়েক ব্যক্তি।
টিপসই নিতে ওই নারীর বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে এগিয়ে নিতেই তিনি চিৎকার করছেন। এ সময় তাকে ‘না’ বলেও চিৎকার করতে শোনা যায়। ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হলে অনেকেই এই অমানবিক ঘটনার বিচার দাবি করেন। নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।
এদিকে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাইরাল ভিডিওটির সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কোনো মিল নেই, বরং উল্টো। জমি লিখে নেয়ার বিষয় থাকলেও আসলে তা ছিল দুই পরিবার এবং ভাইবোনের সমঝোতা ও দেনা-পাওনার ভিত্তিতেই। নারীটি চিৎকার করছিলেন মূলত তার অসুস্থতাজনিত কারণে।
৬৫ বছর বয়সী ওই নারীর নাম জাহানারা খাতুন। তিনি কুষ্টিয়া জেলার ইবি থানার গঙ্গাবরকান্দি গ্রামের ওয়ারেশ আলীর স্ত্রী।
বিষয়টি নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা দলিল লেখক, ওই নারী, তার স্বামী, সন্তান, স্বজন, সাব-রেজিস্ট্রারসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক।
প্রত্যেকেই জানান, তাদের দাবি মহিলাটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তার ইচ্ছায়ই জমি বিক্রি করছিল পরিবারের সদস্যরা।
জাহানার ভাই রইস উদ্দিন বলেন, ‘আমার বোন দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সে ওয়ারিশ সূত্রে ২৯ শতাংশ জমি পাবে। অসুস্থ থাকায় সেই জমির মধ্যে ২৬ শতক জমি তার স্বামী ও সন্তান ২ লাখ ৫০ হাজার মূল্যে আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে জমি বিক্রি করার কথা বলেন। এ জন্য তারা আমার বোনকে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে আসেন। কিন্তু সে অসুস্থ থাকায় টিপসইয়ের সময় চিৎকার করে। জোর করে লিখে নেয়ার কথা সঠিক নয়।’
স্বামী ওয়ারেশ আলী, সন্তান ফিরোজসহ স্বজনরা জানান- জাহানারা প্রায় আড়াই বছর আগে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। তার চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছে। এবার উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই জমি বিক্রির কথা বলা হলে জাহানারার ইচ্ছায়ই তার দুই ভাইয়ের নামে তা রেজিস্ট্রি করার কথা ছিল।
মূলত প্যারালাইজড হওয়ার কারণে দুই হাত নাড়াতে পারেন না জাহানারা। তাই বাম হাতের টিপসই নেয়ার সময় ব্যথা পেয়ে চিৎকার করছিলেন তিনি।
শুক্রবার সকালে জাহানারার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় শুয়ে আছেন তিনি। চলাফেরা, এমনকি নড়াচড়াও করতে পারেন না। শরীরের বাম পাশ পুরো অচল হয়ে গেছে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। কেউ কিছু জানতে চাইলে শুধু হ্যাঁ বা না বলে জবাব দেন।
ভাইদের কাছে নিজের ইচ্ছায় জমি দিচ্ছেন কি না, কয়েকবার এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতির কথা জানান তিনি।
এটি রেজিস্ট্রি করার কথা ছিল গত মঙ্গলবার। সেদিন রেজিস্ট্রি করতে এসে অসুস্থতার কারণে তিনি চিৎকার করছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে হরিণাকুণ্ডু থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পর ওই নারীর স্বামী-সন্তান, ভাইসহ অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। আসলে জোর করে নয়, ওই নারীর ইচ্ছায়ই দলিলে টিপসই নেয়া হয়েছিল।’
স্থানীয় দলিল লেখক নওশের আলী জানান, ওই নারীর ভাই একটি হেবা দলিল (দানপত্র) করার জন্য তার কাছে আসেন। সেই অনুযায়ী, ২৬ শতাংশ জমির একটি দলিল লেখা হয়। পরে গত মঙ্গলবার দলিলে টিপসই নিতে গেলে জাহানারা চিৎকার করার কারণে সেদিন দলিলটি রেজিস্ট্রি না করিয়ে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মেহেদী আল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানতাম না। আপনাদের কাছ থেকেই জেনেছি। এমন দলিল রেজিস্ট্রির কোনো সুযোগ নেই। কারণ রেজিস্ট্রির সময় দাতাকে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়। সেগুলোর সন্তোষজনক জবাব না পেলে জমি রেজিস্ট্রি করা হয় না।’