‘৬০ সেকেন্ডেই জীবন বাঁচাবে মরিচের গুঁড়া’ শিরোনামে একটি পথ্য-পরামর্শ ঘুরছে ফেসবুকে। এতে বলা হয়েছে, হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাণ বাঁচানো সম্ভব মরিচের গুঁড়ার সাহায্যে।
১৮ হাজার ১০০ ব্যবহারকারীর ‘প্রাথমিক শিক্ষক দর্পণ’ একটি ফেসবুক গ্রুপে পোস্টটি দেয়া হয় ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর। পোস্টদাতা হলেন ওই গ্রুপেরই অ্যাডমিন নাজমা ইসলাম।
ছবি আকারে পোস্টটি করেছেন নাজমা ইসলাম। যেখানে লেখা আছে (বাক্য ও বানান অপরিবর্তিত), ‘হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশিরভাগই মারা যান। কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাহলে খুব সহজেই হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষা করতে পারি৷
‘রান্নার কাজে প্রতিটি পরিবারেই শুঁকনো মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। আপনি কি জানেন- এই মরিচের গুঁড়াই হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বাঁচতে পারে? তাহলে চলুন জেনে নিই কীভাবে মরিচের গুঁড়া হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে পারে।
‘একটি গ্লাসে পানি নিন। এতে কিছু পরিমাণ মরিচের গুঁড়া নিয়ে নাড়ুন। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মিশ্রণটি এমনভাবে করতে হবে যেন এটি অনেক বেশি ঝাল লাগে। এরপর মিশ্রণের কয়েক ফোঁটা হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তির জিহ্বার নিচে দিয়ে মুখে দিন। আপনার কাজ শেষ।
‘৬০ সেকেন্ডের মধ্যে দেখবেন হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জন ক্রিস্টোফার বলেন, এটা খুব সহজভাবে ও দ্রুত মানুষের জীবনরক্ষা করার অন্যতম উপায়।’
নাজমা ইসলামের এই পোস্টে বুধবার পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ ফেসবুক ব্যবহারকারী রিঅ্যাক্ট করেছেন। শেয়ার করা হয়েছে ৩২ হাজার বার। আর কমেন্ট জমা হয়েছে ১১২টি।
জেবুন্নেসা ঝুমুর নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী আক্ষেপ করে কমেন্ট করেছেন, ‘ইস আগে যদি জানতাম তাহলে মায়ের জন্য, ভায়ের জন্য চিকিৎসা দিতে পারতাম 😭’
এমন পোস্ট দেয়ায় অনেকে পোস্টদাতাকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন।
মো. ফজলুল হক নামের একজন কমেন্ট করেছেন (বাক্য ও বানান অপরিবর্তিত), ‘সুনদর সংগ্রহ মানুষের কল্যাণে প্রচারিত হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ চলে আসছে বাট আমরা জানি না এবং জানালেও তা মানিনা এখন গবেষকরা বললে তা মানি এবং মানার চেষ্টা করি। প্রচার করে থাকি। ধন্যবাদ।’
এই পোস্টের তথ্যের উৎস অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের যে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জন ক্রিস্টোফারের বরাত দেয়া হয়েছে তার অস্তিত্ব রয়েছে। তার পুরো নাম জন রেমন্ড ক্রিস্টোফার।
আমেরিকান এই ভেষজ ও প্রকৃতিবিদের জন্ম ১৯০৯ সালের ২৫ নভেম্বর, মারা যান ১৯৮৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। তিনি ভেষজ শাস্ত্র নিয়ে অসংখ্য বক্তৃতা ও প্রকাশনার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ৫০টিরও বেশি ভেষজ সূত্র আবিষ্কার করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ রাজ্যের স্প্রিংভিলে দ্য স্কুল অফ ন্যাচারাল হিলিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা।
মরিচের গুঁড়ায় হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি কমে- এমনটি কি বলেছেন জন ক্রিস্টোফার? এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি এ ধরনের টোটকা দিয়েছিলেন। তাকে উদ্ধৃত করে মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত তরলের সাহায্যে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তদের ঝুঁকিমুক্ত করার উপায় সম্পর্কে অনলাইনে বেশ কিছু লেখালেখি পাওয়া গেছে।
মরিচের গুঁড়ার উপকারিতা নিয়ে জন ক্রিস্টোফারের সরাসরি উদ্ধৃতিও পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। তিনি বলেছেন, ‘৩৫ বছরের চিকিৎসাজীবনে এবং মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিংবা শিক্ষাদানের সময়ে আমি কখনই জরুরি পরিস্থিতিতে হার্ট অ্যাটাক-আক্রান্ত একজন রোগীকেও হারাইনি। এর কারণ হলো, খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে যখনই দেখেছি তারা তখনও শ্বাস নিচ্ছেন- আমি তাদের মরিচের গুঁড়া মিশ্রিত চা (এক কাপ গরম পানিতে এক চা চামচ মরিচ গুঁড়া) খেতে দিই। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন।’
এই পদ্ধতি হৃৎপিণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টোটকা দাবি করে তিনি বলেন, এই টোটকায় হৃদযন্ত্র দ্রুত সাড়া দেয়। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, শীতল চায়ের চেয়ে এই উষ্ণ চা দ্রুত কাজ করে। কারণ এটা ধমনির মাধ্যমে দ্রুত হৃৎপিণ্ডে পৌঁছায়। তবে ফেসবুকে যেভাবে মরিচের গুঁড়ার তরল হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর জিহ্বার নিচে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, জন ক্রিস্টোফার সে ধরনের কোনো পরামর্শ দেননি। তার পরামর্শ, গরম পানিতে এক চামচ মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্য পাকা মরিচের উপকারিতার তথ্য স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটেও পাওয়া গেছে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্য বলছে, লাল মরিচ বিভিন্ন উপায়ে হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে। এটি প্রদাহ প্রতিরোধক। এই প্রদাহ হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। লাল মরিচ রক্তনালিকে সুস্থ রাখতে পারে এবং রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
গবেষকরা দেখেছেন, যারা নিয়মিত মরিচ খান এবং মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলেন, হার্ট অ্যাটাকে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম।
২০০৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, জিহ্বায় থাকা যে স্নায়ু রিসেপ্টর মরিচের ঝাল অনুভবে কাজ করে, সেই একই রিসেপ্টর হার্ট অ্যাটাকের সময় বুকে ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টি করে থাকে।
তবে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মরিচের গুঁড়ার সাহায্যে হৃদরোগ চিকিৎসার সম্ভাবনা নাকচ করছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা চিকিৎসক সোহেল হায়দার চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মরিচের গুঁড়া হৃদরোগের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’
ফেসবুকের পোস্টটি তার চোখে পড়েনি জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘মেডিক্যাল সায়েন্স বা অন্য কোনো চিকিৎসায় এ পদ্ধতিতে এ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নেই।’
এ ধরনের পোস্টের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের টেনশন নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের পরিচালক মাহফুজুর রহমানও বললেন, হৃদরোগের চিকিৎসায় এমন কোনো টোটকার তথ্য তিনি কখনও শোনেননি।
এই হৃদরোগ চিকিৎসক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো তথ্য মেডিক্যাল সায়েন্সে আছে কি না আমার জানা নেই। যদি থাকত, যেহেতু আমি হার্ট নিয়ে কাজ করি, অবশ্যই আমি এ বিষয়ে জানতাম।’
মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু এমন পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
বরং মরিচের গুঁড়া ব্যবহার নিয়ে উল্টো সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের শরীরের অবস্থা অনুযায়ী এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। অনেকের এটার কারণে মুখে ঘা দেখা দিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে একটু ঝাল লাগার পর তা ঠিক হয়ে যেতে পারে। তবে এটার ব্যবহার না করাই উত্তম।’