ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাজারে কচুর লতি বিক্রি করে ভাইরাল অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্সের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলেছে একটি পক্ষ। এ অধ্যাপক বলছেন, কৃষি খামার করার কারণেই তিনি প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন।
গত শুক্রবার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বাবুলের বাজারে কচুর লতি বিক্রি করতে নিজেই বসেছিলেন প্রিন্স। এক ব্যক্তি সেখানকার কয়েকটি ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে সেটি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এতে সব মহলের প্রশংসায় ভাসেন তিনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
এরই মধ্যে ওই ইউনিয়ন থেকে নিউজবাংলার প্রধান কার্যালয়ে অধ্যাপক প্রিন্সের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ আনে একটি পক্ষ। গড়ে তোলা কৃষি খামারে গারো সম্প্রদায়ের অনেকের জমি ওই অধ্যাপক তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে দখল করেছেন বলে জানানো হয়।
এ ব্যাপারে খোঁজখবর করে নিউজবাংলা। মঙ্গলবার দিনব্যাপী অনুসন্ধানে কথা বলা হয় জমি বিক্রেতাদের সঙ্গে।
জমি বিক্রেতাদের একজন হরেং সাংমা। তিনি একসময় ওই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। জমি দখল করে নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ লোকমুখে জানতে পারি আমাদের ইউনিয়নের জামাই অধ্যাপক প্রিন্স কৃষি খামার করতে জমি খুঁজছেন। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তার কাছে জমি বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি নগদ টাকা দিয়ে জমি কেনেন। তিনি জমি দখল করেননি।’
স্বপন মারাক নামে আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আট একর জায়গায় এত বড় বাগান কেউ গড়ে তুলতে পারেনি। প্রিন্স বাগান করতে চাইলে আমি ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট ৫ একর জায়গা তার কাছে বিক্রি করেছি। জমি দখলের মিথ্যা অভিযোগ প্রিন্সের শ্বশুরের প্রতিপক্ষরাই ছড়িয়ে দিচ্ছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, তারাও এমন অভিযোগ শুনেছেন যে অধ্যাপক প্রিন্সের গড়ে তোলা লটকন বাগানের জমিগুলো তার না। নূরুল ইসলাম নামে একজনের জমি দখলে নিয়েছেন তিনি।
নূরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি আট কাঠা জমি হরেং সাংমার কাছ থেকে কিনেছিলাম। কয়েক বছর আগে আর্থিক সমস্যায় পড়ে প্রিন্সের কাছে দুই কাঠা জমি বিক্রি করি। তিনি নগদ টাকাও দিয়েছেন। আসলে তাদের অনেক শত্রু রয়েছে। তারা বেনামে মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্স নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২০০৬ সাল থেকে জমি কিনতে শুরু করি। ২০১৪ সালে কৃষি খামারের কার্যক্রম শুরুর সময় আমি অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বাগানের ভেতর থাকার জন্য টিনের ঘর করেছি। তখন টিনের চালে প্রতিদিন ইটপাটকেল ছোড়া হতো। কিন্তু আমি ঘাবড়ে যাইনি। এগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়েছে। আমার স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকে। এ জন্য আমাকে নারী কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িয়ে দিতে গোপনে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমি সব সময় সচেতন থাকার কারণে সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।’
ড. আবু বকর সিদ্দিক প্রিন্সের শ্বশুর শহীদুজ্জামান আকন্দ হবি এ উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের দুইবারের চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া ওই ইউনিয়নে বাবুগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
অধ্যাপক প্রিন্স বলেন, ‘আমার শ্বশুর মারা গেলেও সব শত্রুরা মারা যায়নি। শ্বশুরের একমাত্র ছেলে ঢাকায় থাকেন। এদিকে আমি একা এখানে এত বড় বাগান করি, এটি প্রতিপক্ষের সইছে না। এ জন্যই আমাকে হয়রানি করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তারা পারবে না। কারণ, জমির সব দলিল আমার কাছে রয়েছে।’
প্রিন্স বলেন, তিনি তার প্রতিপক্ষের নাম বলবেন না। তবে, তারা তাকে সরিয়ে দিতে চায়, কেননা তাতে বনের জমিসহ গারো সম্প্রদায়ের লোকজনের জমি দখলে নিতে পারবে।
বরিশালের ঝালকাঠির রাজাপুরে প্রিন্সের দাদার বাড়ি। তবে বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন প্রিন্স। ২০০২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। এরপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি ব্যবসায় এমবিএ করেন ২০০৮ সালে। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও ২০১৮ সালে পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি বরিশাল ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ প্রিন্সের। এ জন্য ঢাকায় নাগরিক জীবন ছেড়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামে তার শ্বশুরের এলাকায় আট একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। নাম দিয়েছেন ‘কিষাণ সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ’। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরের ছয় মাস ছুটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য চাষ করছেন তিনি এখানে।
খামারে আছে তিন প্রজাতির ড্রাগন ফলের ৫ হাজার গাছ। এ ছাড়া মাহালিশা, কিউজাই, ব্রুনাই কিং, বাউ-৪, কাঁচামিঠা, তাইওয়া গ্রিন, কাটিমন, পালমার, মল্লিকাসহ ১০ প্রজাতির আমগাছ। চায়না থ্রি, মঙ্গল বারিসহ তিন প্রজাতির লিচু ছাড়াও মিসরীয় শরিফা, স্ট্রবেরি, চেরি, থাই পেয়ারা, আম, লেবু, জাম্বুরা, লটকন, মাল্টা, সফেদা, আতাফল, কতবেল, আমলকী, ডেউয়া, ডুমুর, কাঠবাদাম, জামরুল, থাই জাম্বুরা, লটকন, মাল্টা ও কলাসহ বিভিন্ন ফলের গাছ সারিবদ্ধভাবে লাগানো রয়েছে।
বাগানের ভেতরে ৫০ শতাংশ আয়তনের একটি পুকুরে তিনি চাষ করছেন দেশি প্রজাতির মাছ। পুকুরপাড়ে রাজহাঁস আর চীনা হাঁসের ছোট্ট একটি খামারও রয়েছে। পুকুরপাড়ে একটি শেডে কিছু গবাদিপশুও লালন-পালন করছেন তিনি। এর পাশেই করেছেন ধানের ক্ষেত।
এ কৃষি খামারে উৎপাদিত বিষমুক্ত খাদ্যপণ্য বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। এ কাজে সহায়তা করেন কয়েকজন শ্রমিক। এর মধ্যে শ্রমিক সংকট দেখা দিলে স্থানীয় বাজারে নিজেই পণ্য নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন তিনি৷