বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মোয়ামোয়ায় তছনছ রেমিনের জীবন

  •    
  • ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ১৬:৫৯

রেমিনের পরিবার মনে করছে বাজির শব্দেই তছনছ হয়ে গেছে তাদের সাজানো পরিবার। তবে ঢাকা ও ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসাপত্রে রেমিন মস্তিষ্কের ধমনিসংক্রান্ত জটিল রোগ মোয়ামোয়ায় আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল স্ট্রোকের পাঁচ বছর আগে থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ শব্দের সঙ্গে মোয়ামোয়া রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।

শারমিন জামান রেমিন ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। ক্লাস ফাইভ ও এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসিতে পেয়েছে গোল্ডেন এ প্লাস। এরপর জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ আঘাত।

২০১৭ সালে জুনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে থমকে যায় রেমিনের স্বাভাবিক জীবন। তার পরিবারের দাবি, বাড়ির পাশে ফোটানো বাজির শব্দে ব্রেইন স্ট্রোক হয় রেমিনের। এরপর থেকে সে প্যারালাইজড। ২১ বছরে পৌঁছানো মেয়েটি এখন বলতে গেলে শয্যাশায়ী।

রেমিনের বাবা জাহিদ রিপন নিউজবাংলাকে জানান, ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরে থাকতেন তারা। ঈদুল ফিতরের দুদিন আগের রাতে বাসার পাশে বিকট শব্দে বাজি ফোটাতে শুরু করে এলাকার কিছু শিশু। আর সেই শব্দে ব্রেইন স্ট্রোক হয় রেমিনের। এতে একপাশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে যায়। দেশে-বিদেশে চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও তার ডান হাত আর ডান পা প্যারালাইজড।

সাড়ে চার বছর আগের ঘটনাটির রাতের বর্ণনা দিয়ে জাহিদ রিপন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঈদের দুই দিন আগে আমার বাসার পাশে বাচ্চারা বাজি ফুটাচ্ছিল। আমি তাদের বলেছি, এদিকে ফুটাইয়ো না, ওই দিকে যাও। আমি না করার পরেও শোনেনি, আবার একটু পরে আসছে।

‘রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমার মেয়ে আমার পাশে বসা। আমরা খাচ্ছি। এমন সময় বোমার মতো শব্দে একটা বাজি ফুটেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছি। পরে ও আর ভাতটা খেতে পারল না। এরপর রাতে ঘুমিয়েছে কি না আমরা অতটা খেয়াল করতে পারিনি। সকালবেলা আমি একটা প্রোগ্রামে ফরিদপুরের বাইরে চলে গেছি। ওর আম্মু ফোন করে জানাল, ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা কেমন যেন করছে।‘

তিনি বলেন, ‘বাসায় ফিরে এসে মেয়েকে মেডিক্যালে নিলাম। সেখানে ডাক্তার দেখে রোগটা ধরতে পারেননি। উনি ওষুধ দিয়ে বললেন, রাতে মনে হয় স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছে, ঠিক হয়ে যাবে। এরপর দুপুর পর্যন্ত যখন ঠিক হলো না, তখন আরেক জন ডাক্তার ফরিদপুর মেডিক্যালের সহযোগী অধ্যাপক আহাবউদ্দিনকে দেখালাম। উনিও দেখে বের করতে পারলেন না, বললেন ঢাকায় নিয়ে যান।‘

ঢাকায় এনে রেমিনকে ১০ দিন স্কয়ার হাসপাতালে রাখা হয়। অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদের অধীনেও তার চিকিৎসা চলে। পরে রেমিনকে ভারতের ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতালে নিয়ে যান জাহিদ রিপন। সেখানে ডা. আরি জর্জ চাকোর অধীনে চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল। তবে তিনি তখন বাংলাদেশে ছিলেন।

এরপর রেমিনকে দেশে ফিরিয়ে এনে স্কয়ার হাসপাতালে ডা. আরি জর্জ চাকোর অধীনে অস্ত্রোপচার করানো হয়। ঢাকায় ফেরার আগে ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালেও দেখানো হয় তাকে। তবে এত চিকিৎসার পরেও এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি রেমিন।

রেমিনের কেন এই দুর্বিষহ জীবন

রেমিনের পরিবার মনে করছে বাজির শব্দেই তছনছ হয়ে গেছে তাদের সাজানো পরিবার। তবে ঢাকা ও ভারতে চেন্নাইয়ে চিকিৎসাপত্রে রেমিন মস্তিষ্কের ধমনিসংক্রান্ত জটিল রোগ মোয়ামোয়ায় আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জনস হপকিন্স মেডিসিন ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, মোয়ামোয়া মস্তিষ্কের ধমনির একটি দীর্ঘস্থায়ী ও ক্রমাগত বাড়তে থাকা রোগ। মোয়ামোয়া রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের রক্তনালিগুলো সরু হয়ে যায়। এর ফলে ধমনি ব্লকও হয়ে যেতে পারে এবং এ থেকে ইসকেমিক স্ট্রোক (রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক), রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক ও খিঁচুনি হতে পারে।

জনস হপকিন্স মেডিসিন ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে মোয়ামোয়া রোগ বেশি দেখা যায়। আর পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের আক্রমণ করতে পারে।

নারী ও বংশগতভাবে এশিয়ানদের মধ্যে মোয়ামোয়া রোগের ঝুঁকি বেশি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই রোগটির সঙ্গে জিনগত যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

মোয়ামোয়া শব্দটি জাপানি। এর অর্থ ঝাপসা ধোঁয়া বা মেঘ। মোয়ামোয়া আক্রান্ত রোগীদের এনজিওগ্রামে (মস্তিষ্কের স্ক্যান) রক্তনালিগুলোকে ঠিক তেমনটাই দেখা যায়। ওষুধ বা অস্ত্রোপচার করে লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই এর চিকিৎসা পদ্ধতি।

মোয়ামোয়া রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জনস হপকিন্স মেডিসিন ইন্টারন্যাশনালের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগে আক্রান্তদের ছোটখাটো স্ট্রোক হতে পারে, কারও ক্ষেত্রে মৃগীর লক্ষণ থাকতে পারে। এ ছাড়া ধমনিতে ব্লকের কারণে ইসকেমিক স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক করতে পারে। শরীরের যেকোনো একদিকে দুর্বলতা বা পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে এবং ক্রমাগত স্ট্রোক ও রক্তক্ষরণের কারণে চিন্তাশক্তি ও স্মৃতিশক্তি ক্রমশ কমতে পারে।

স্কয়ার হাসপাতালে ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট রেমিনের চিকিৎসাপত্রের একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। ডা. আরি জর্জ চাকোর সই করা ওই নথিতে রেমিন মোয়ামোয়া রোগে আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে সংক্ষিপ্ত ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রিতে বলা হয়, ১৬ বছর বয়সী মেয়েটি আমাদের কাছে একটি হুইলচেয়ারে চড়ে এসেছে। তার শরীরের ডান দিকে পাঁচ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান ব্যথা ছিল। কৈশোর থেকে তার দুর্বলতা ছিল। পাঁচ বছর আগে লেখার সময় প্রথমবার তার দুর্বলতা ধরা পড়ে। এবং সাত মাস আগে তার মুখে দুর্বলতা শুরু হয় ও কথায় জড়তা চলে আসে। এর দুই দিনের মধ্যে তার ডান দিকের অংশে দুর্বলতা শুরু হয়। তখন থেকে তিনি হাঁটতে পারেন না। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ও ডান দিকে ফিজিওথেরাপি দেয়া হয়।

এর আগে ওই বছরের ১০ জুলাই এস.পি.আর.সি. অ্যান্ড নিউরোলজি হাসপাতালের দেয়া ছাড়পত্রে রেমিন মোয়ামোয়া রোগে আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এই হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদের অধীনে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ভারতের ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও অ্যাপোলো হাসপাতালের নথিপত্রেও রেমিন মোয়ামোয়া রোগে আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নথির কোনোটিতেই উচ্চশব্দজনিত কারণে রেমিনের অসুস্থতার বিবরণ নেই। এসব চিকিৎসাপত্রের অনুলিপি নিউজবাংলার কাছে থাকলেও রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার নীতি অনুসরণ করে সেগুলোর ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে না।

রেমিনের বাবা বলছেন, বাজির বিষয়টি জানানো হলেও চিকিৎসকরা তা আমলে নেননি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়াজের থেকে যে হয়েছে এটা ডাক্তাররা মানতে চান না। এই ঘটনাটা যখন ঘটল তখন আমি তো ওর (রেমিন) পাশে বসা। এর আগে-পরের সবকিছুই তো আমি জানি। কিন্তু ডাক্তাররা ওইটাকে (বাজির শব্দ) কিছু বলতে চান না। তারা বলেন যে এই (মোয়ামোয়া থেকে) সমস্যা হচ্ছে।’

রেমিনের ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রিতে পাঁচ বছর আগে থেকেই সমস্যা থাকার বিষয়টি উল্লেখ থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে জাহিদ রিপন বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে ভোগা বলতে সে আসলে একটু ভীতু প্রকৃতির ছিল। ও শব্দ বেশি নিতে পারত না। একটু চুপচাপ থাকত। তবে এরপরেও সে ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে, এইটে বৃত্তি পেয়েছে, এসএসসিতে সে এ প্লাস পেয়েছে। সে একটু ভীতু প্রকৃতির ছিল। সেটার জন্য তো আমরা ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে ছিলাম। এটার জন্য অন্য কোনো সমস্যা ছিল না।’

‘ভীতু প্রকৃতির’ ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘স্নায়ু দুর্বল ছিল আরকি। মানে দুর্বল চিত্তের কিছু মানুষ থাকে না- যারা কিছু দেখলে ভয় পায়, আওয়াজ নিতে পারে না। ও দুর্বল চিত্তের ছিল।

‘সে প্রাণী দেখে ভয় পায় না। সে শুধু শব্দ নিতে পারত না। কুকুর ঘেউ করে উঠলেও সমস্যা। বাসার সামনে মোটরসাইকেল হর্ন দিলেও সমস্যা। আমার বাসাটা তো তিন রাস্তার মোড়ে। আমি সে কারণে নিজের এই বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় চলে গিয়েছিলাম। পরে আর্থিক কারণে ফিরে আসি। আমি নিজের বাড়ি রেখে তিন বছর বাইরে ছিলাম। অন্য বাসায় ভাড়া ছিলাম।’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

শারমিন জামান রেমিনের শারীরিক অবস্থা ও মোয়ামোয়া রোগটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতিমার সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।

শিশু নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. কানিজ বলেন, ‘মোয়ামোয়া রোগটি মূলত মস্তিষ্কের একটি সমস্যা। মস্তিষ্কের যেসব রক্তনালি থাকে সেগুলো জন্মগতভাবে বা পরবর্তী সময়ে সরু হয়ে যায়। এ কারণে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এটা মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হতে পারে ও পরবর্তীতে স্ট্রোক হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘মোয়ামোয়া রোগে মস্তিষ্কের কোনো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ওই অঞ্চলে যে কাজগুলো থাকে মস্তিষ্ক সেটা আর করতে পারে না। ফলে শরীরের একটা পাশ অবশ হয়ে যেতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে, মাথাব্যথা হতে পারে। এ কারণে মৃত্যুও হতে পারে।’

ডা. কানিজ ফাতিমা বলেন, ‘আমরা যেমনটা পাই যে ৩-৪ বছর থেকে সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে এটা জন্মগত সমস্যা বলে জন্মের সময় থেকেও সমস্যা দেখা যেতে পারে। তবে সেটা খুবই বিরল। বেশির ভাগ সময় ৩-৪ বছর বা ২ বছরেও পাই। এটা বড়দেরও হতে পারে।’

উচ্চ শব্দের সঙ্গে মোয়ামোয়া রোগের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান ডা. কানিজ। শব্দের কারণে ব্রেইন স্ট্রোকের সম্ভাবনাও নাকচ করেছেন তিনি।

বিএসএমএমইউর এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘শব্দের কারণে ব্রেইন স্ট্রোক হয় এমনটা আমরা কখনও শুনিনি। তবে কোনো শিশু অনেক বেশি অসুস্থ থাকলে সে শব্দ থেকে ভয় পেতে পারে। কিন্তু শব্দের কারণে ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা নেই।’

এ বিভাগের আরো খবর