বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দেশি মাছে প্লাস্টিক কণা কি সারা দেশেই?

  •    
  • ২৩ আগস্ট, ২০২১ ২০:০৮

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নদী বা অন্য জলাধারে দূষণের মাত্রার ওপরে মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। সে ক্ষেত্রে গ্রামে বা হাওর অঞ্চলে এই একই প্রজাতির মাছে প্লাস্টিক নাও পাওয়া যেতে পারে।

দেশি ১৫ প্রজাতির মাছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার (মাইক্রোপ্লাস্টিক) উপস্থিতি পাওয়ার খবর সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। তবে গবেষণায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা কেবল দুটি এলাকার কিছু মাছের নমুনা নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার ফলাফল পুরো দেশের চিত্র প্রকাশ করে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সুমাইয়া জান্নাত স্নাতকোত্তর শ্রেণির থিসিসের জন্য তিনি গবেষণাটি করেন। তত্ত্বাবধানে ছিলেন বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক ও সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভিন।

‘অ্যাবানড্যান্স, ক্যারেকটারিসটিকস অফ মাইক্রোপ্লাস্টিক ইন ডিফারেন্ট ফ্রেশ ওয়াটার ফিশ স্পিশিজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণা নিবন্ধটি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার জন্য ঢাকার পাশের দুটি এলাকা সাভার ও আশুলিয়ার বাজার থেকে ১৮ দেশীয় প্রজাতির ৪৮টি মাছ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন সুমাইয়া জান্নাত। এর মধ্যে ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

এই মাছগুলো হলো: রুই, তেলাপিয়া, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি, কালবাউশ, বেলে, টেংরা, কই, বাটা ও বাছা। পরীক্ষায় টেংরা মাছে সবচেয়ে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এরপর রয়েছে টাটকিনি ও রয়না মাছ।

তবে গবেষণায় ফলি, শিং ও গুলশা মাছে কোনো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।

গবেষণাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব জলাধার থেকে নমুনা মাছগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। ফলে উদ্বেগজনক ফলাফলটিকে সারা দেশের চিত্র হিসেবে ধরে নেয়ার সুযোগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নদী বা অন্য জলাধারে দূষণের মাত্রার ওপরে মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। সে ক্ষেত্রে গ্রামে বা হাওর অঞ্চলে এই একই প্রজাতির মাছে প্লাস্টিক নাও পাওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাধারে দূষণের মাত্রার ওপরে নির্ভর করছে মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়ার বিষয়টি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

কোথা থেকে এলো প্লাস্টিক?

গবেষক সুমাইয়া জান্নাত মাছগুলো কিনেছিলেন সাভার ও আশুলিয়া বাজার থেকে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, কেনার সময় মাছ বিক্রেতার সঙ্গে কথোপকথনে জেনেছেন সাভারের আশপাশের নদ-নদী যেমন তুরাগ, ধলেশ্বরী থেকে মাছগুলো আনা হয়েছে। এ ছাড়া ছিল কিছু চাষের মাছ।

এসব মাছের পেটে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা কীভাবে আসতে পারে জানতে চাইলে সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা মূলত মাছের পেটে তিন ধরনের প্লাস্টিক পেয়েছি। একটা হচ্ছে হাইডেনসিটি পলিথিন (এইচডিপি), আর একটা মূলত যে শ্যাম্পুর বোতল, জুসের বোতল বা ফার্মিংয়ের কাজে যে পাইপ ব্যবহার করা হয় সেখান থেকে আসে। এগুলোতে হাইডেনসিটি পলিথিন থাকে।’

ব্যাখ্যা দিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘আমরা যখন এগুলো ব্যবহার করে বাইরে ফেলে দিই, তখন অনেক দিন ধরে সূর্যের আলোতে তাপ পেয়ে ভেঙে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। এরপর পানিতে পৌঁছায়।

‘আর এক ধরনের হচ্ছে পলিথিন বা পলিইথিলিন যেটা আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করে থাকি। আমরা প্রতিদিন এই পলিথিন পানিতে ফেলে দিই।’

পলিথিন কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয় সেটির ব্যাখ্যায় সুমাইয়া বলেন, ‘সূর্যের আলোতে এগুলোর পলিমারের কাঠামো ভাঙতে থাকে। এটা খুব দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া। আর একটা হচ্ছে ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট। এটা মূলত বিভিন্ন র‌্যাপিং পেপার থেকে আসে। মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবার ভেবে গ্রহণ করে অনেক মাছ।’

কেন তিন প্রজাতিতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি নেই

১৮ প্রজাতির মাছ নিয়ে গবেষণা করা হলেও তিনটিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।

ফলি, শিং ও গুলশা মাছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি না থাকার কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে সুমাইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নমুনার জন্য বেছে নেয়া মাছগুলো মূলত খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিক কনজিউম করেছে। যেহেতু ওই তিনটা মাছে প্লাস্টিক পাওয়া যায়নি, তার মানে তারা সেটি খায়নি। গবেষণায় আমরা দেখেছি যে মাছগুলো পানির সবচেয়ে নিচের স্তরে আছে, তাদের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বেশি। তবে শিং মাছ ওই একই স্তরে থাকলেও তার মধ্যে কোনো প্লাস্টিক পাওয়া যায়নি।’

জলাশয়ের দূষণের মাত্রার হেরফেরও কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘তিন ধরনের মাছে প্লাস্টিক না পাওয়ার বড় কারণ হতে পারে আমরা যে মাছটি কিনেছি, সেটি যেখান থেকে ধরা হয়েছে সেই পানিতে হয়তো প্লাস্টিকের উপস্থিতি ছিল না। আবার মাছের বয়সের ওপরেও বিষয়টি নির্ভর করতে পারে। অনেক সময় মাছ ছোট হলে সে প্লাস্টিক হয়তো খেতে পারবে না। আস্তে আস্তে বড় হলে খাবারের সঙ্গে এটার পরিমাণ বাড়তে পারে।’

সুমাইয়া জান্নাতের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খাদ্যাভ্যাস একটা কারণ হতে পারে। তবে মাছের বসবাসের জায়গাগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘একটা নদীর বা লেকের তিনটা পার্ট থেকে থাকে। আপার, লোয়ার ও মিডল পার্ট। যখন কোনো প্লাস্টিক পানিতে ফেলা হয়, সেটি তখন আপার পার্টে ভাসতে থাকে। এটা যখন ভারী হয়ে আসে, তখন ডুবে গিয়ে নিচের অংশে পানিতে চলমান থাকে। আমি এখনও নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারছি না, তবে আমরা ধারণা করছি যেসব মাছ পানির নিচু স্তরে বা বটম লেয়ারে থাকে সেই অংশের মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক বেশি থাকে।’

গবেষণাটি একেবারেই ‘প্রাথমিক পর্যায়ের’ বলে স্বীকার করছেন সুমাইয়া জান্নাত। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ল্যাবরেটরিতে বড় আকারে পরীক্ষা করতাম তবে ক্লিয়ার ফাইন্ডিংস পাওয়া যেত। এতে মাছের খাদ্যাভ্যাস থেকে সবকিছুই জানা যেত। আমি মনে করি এটা একদম প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ। এ বিষয়ে আরও গবেষণা লাগবে।’

দেশের সামগ্রিক চিত্র নয়

গবেষণাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমিত পরিসরের এই গবেষণা দিয়ে বেশির ভাগ দেশীয় মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি রয়েছে, এমন সিদ্ধান্ত টানা যাবে না।

অধ্যাপক শফি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সামগ্রিকভাবে বলতে পারব না যে, দেশের সব অঞ্চলেই এই ১৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। কারণ আমরা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, যেটি আরবান এরিয়া তা নিয়ে গবেষণা করেছি। তাই সামগ্রিকভাবে বলাটা ঠিক না। আমরা তো অন্য অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করিনি, কেবল আরবান সেটিংয়ে করা হয়েছে।’

একই ধরনের মত দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনূর রশিদ।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক মূলত মাছের খাদ্যের মাধ্যমে ঢোকে। সাধারণত পানি যদি প্লাস্টিক কণা দিয়ে দূষিত থাকে, তখনই তাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকতে পারে।

‘এটি মূলত দূষণের ওপর নির্ভর করে। যদি বিশুদ্ধ পানির নদী বা দূষণ নাই এমন নদী হয়, তবে সেখানে মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাবে না। যেমন আমরা যদি হাওর অঞ্চলের কথা বলি, সেখান থেকে একই প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করলে দেখা যাবে তাতে মাইক্রোপ্লাস্টিক নাই, বা থাকলেও খুব নগণ্য। তবে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর ক্ষেত্রে সেটি উল্টো হবে। কারণ এখানে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক নদীতে ফেলা হচ্ছে।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের দেশের যে বড় নদীগুলো আছে, সেগুলোর উৎপত্তিস্থল কিন্তু দুটি জনবহুল ও দূষিত দেশ থেকে। তাই এখানে প্লাস্টিক পাওয়া স্বাভাবিক। এটার দায় আমাদের একার না।’

কী ক্ষতি হতে পারে?

মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকলে সেটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ বলেন, ‘সার্বিকভাবে এটি একটি সিনথেটিক কেমিক্যাল। প্রতিনিয়ত এ ধরনের কেমিক্যাল আমাদের মার্কেটে আসছে। এর একটা বিরাট অংশের হেলথ ইফেক্ট আমাদের জানা নেই, তবে নেগেটিভ প্রভাব আছে। বিশেষ করে প্লাস্টিককেন্দ্রিক যে পলিমার সেটির কারণে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।’

সুমাইয়া জান্নাত বলেন, ‘এটা ধারণা করা হয় যে, এই প্লাস্টিক যখন তার বন্ধন থেকে ভেঙে বের হয়ে আসে, তখন এটা মাছের পেশিতে ও পর্যায়ক্রমে মানুষের দেহে আসতে পারে। এটা মানুষের হরমোনাল ফাংশনে বাধা দেবে। ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলো সবই বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে।’

এ বিভাগের আরো খবর