সারা বিশ্বে মুখে মুখে ছড়ানো কথাটি ছিল, অ্যালিসা কার্সন নামের এক তরুণী প্রথম মানুষ হিসেবে মঙ্গল গ্রহে পা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে ২০ বছর বয়সী কার্সনের ‘আত্মত্যাগের’ প্রশংসা করেছে কোটি কোটি মানুষ।
‘এক্সপ্লোর স্পেস’ কর্মসূচির জন্য কেনেডি স্পেস সেন্টার ভিজিটর কমপ্লেক্সের পাসপোর্ট পাওয়া প্রথম ব্যক্তি কার্সন। তিন বছর বয়স থেকে মহাকাশের টানে নভোচারী হওয়ার স্বপ্নের শুরু তার।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল অ্যালিসা কার্সনবিষয়ক সব পোস্ট।
ফেসবুকে ‘স্পেস টাইম’ পেজে গত ৬ জুলাই প্রকাশিত একটি পোস্টে লেখা ছিল, ‘এই তরুণী বিয়ে করতে পারবেন না; পারবেন না সন্তান জন্ম দিতেও। কারণ প্রথম মানুষ হিসেবে মঙ্গলে পা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আর কোনো দিনই ফিরবেন না পৃথিবীতে।’
ইউএসএ টুডের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে ফেসবুক পেজটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল পত্রিকাটি। এতে বেরিয়ে এসেছে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের কথা।
অ্যালিসা কার্সন মঙ্গলে পৌঁছানো প্রথম মানুষ হতে চান ঠিকই। কিন্তু তিনি মঙ্গলে যাচ্ছেনই, এমন কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি। তিনি এখন পর্যন্ত নভোচারীই হননি।
ভাইরাল ফেসবুক পোস্টটিতে পৃথিবীতে ফিরে আসার বিষয়ে তার পরিকল্পনাও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
অবশ্য এবারই প্রথম কার্সন অপপ্রচারের শিকার নন। ২০১৮ সালেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে একটি গুজব ছড়িয়েছিল, যা পরে মিথ্যা প্রমাণ হয়।
মঙ্গল অভিযানে কার্সনের অংশগ্রহণ চূড়ান্ত হয়নি
অ্যালিসা কার্সন মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মঙ্গলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জীবনের বড় সময় তিনি কাটিয়েছেন মহাকাশবিষয়ক বিভিন্ন ক্যাম্প আর অত্যাধুনিক প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার উপস্থিতি নিয়মিত। সাবেক নারী নভোচারীদের সঙ্গেও রেখেছেন যোগাযোগ।
কার্সনের লিংকডইন পেইজের বরাত দিয়ে তার বাবা বার্ট বলেন, ‘যখন মঙ্গল অভিযান অংশগ্রহণের জন্য আবেদন চাওয়া হবে, তখন বাছাইকৃতদের একজন হতে প্রস্তুত হচ্ছে আমার মেয়ে। শুধু নাসার দিকে তাকিয়ে না থেকে এরই মধ্যে নিজের দারুণ একটি জীবনবৃত্তান্তও তৈরি করেছে সে।’
কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযানের জন্য এখনও নির্বাচিত হয়নি কার্সন।
নাসার মুখপাত্র ক্যাথরিন হ্যাম্বলটন ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন, সংস্থাটির সঙ্গে কার্সনের কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই। আর মঙ্গল অভিযানের অংশ নিতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো কোনো কার্যক্রমও শুরু করেনি নাসা।
তিনি বলেন, ‘নাসার প্রধান লক্ষ্যগুলো আর সামগ্রিকভাবে মহাকাশ ভ্রমণের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জানাতে আমাদের অনেকগুলো কর্মসূচি আছে। শিক্ষার্থীরা এসব কর্মসূচিতে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখালে আমরাও অনুপ্রাণিত হই।
‘কিন্তু তার মানে এই নয় যে কার্সনের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক আছে।’
নাসার এ ধরনের অভিযানের পরিকল্পনাও বেশ সুদূরপ্রসারী। অন্তত ২০৩০-এর দশকের আগে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর কোনো পরিকল্পনাই নেই সংস্থাটির।
এ ছাড়াও নাসার এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে নভোচারীদের যে প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, তাতেও অনেকটা পিছিয়ে কার্সন।
নভোচারী হতে হলে নাসার প্রথম শর্তই হলো প্রকৌশল, জীববিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স বা গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা। একই সঙ্গে ওই বিষয়ের ওপর দুই বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে প্রার্থীর।
এয়ারক্রাফট ওনার্স অ্যান্ড পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, কার্সন ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সবেমাত্র স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করছেন।
নাসার বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাধারণত বয়সের কোনো নির্দিষ্টসীমা বেঁধে দেয়া হয় না। তবে এতদিন পর্যন্ত যাদেরই এ ধরনের কর্মসূচির জন্য বাছাই করা হয়েছে, তাদের বয়স ২৬ থেকে ৪৬ বছরের মধ্যে। গড় বয়স ৩৪ বছর।
কার্সন এখন সবে ২০ বছর পেরিয়েছেন।
অভিযানের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীতে ফেরা
কার্সন আগে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছিলেন যে মঙ্গলে ভ্রমণ করলেও পৃথিবীতে ফিরে আসতে চান। তবে অভিযানের ওপর নির্ভর করে অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতে হলে পিছু হটবেন না বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে টিন ভোগ পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে কার্সন বলেছিলেন, ‘আমি সবসময় নভোচারী হওয়ার কথা ভেবে এসেছি। কারণ আমি মঙ্গলে যেতে চাই। তারপর ফিরে এসে শিক্ষক বা রাষ্ট্রপ্রধান হতে চাই।’
নাসা মুখপাত্র হ্যাম্বলটন জানান, চাঁদ ও এর আশপাশে দীর্ঘমেয়াদে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় নাসা। লক্ষ্য- মঙ্গল অভিযানের জন্য নভোচারীদের প্রস্তুত করা। তবে নভোচারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই শেষ লক্ষ্য থাকবে শেষ পর্যন্ত।
আর কার্সনের বাবা বার্ট জানান, মঙ্গল ভ্রমণ শেষে পৃথিবীতে ফেরার পথ না থাকলেও গ্রহটিতে যেতে চান তার মেয়ে।
তিনি বলেন, ‘নাসা মহাকাশে মানুষ পাঠিয়ে তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠান হয়তো একইভাবে কাজ করবে না।’
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘মার্স ওয়ান’ প্রকল্পের কথা। বেসরকারি অর্থায়নে ওই প্রকল্পে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল।
তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, লাল গ্রহে এই ভ্রমণ হবে ‘একমুখী’। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ২০ বছরের মধ্যে মানুষকে মঙ্গলে পাঠানোর এটাই একমাত্র উপায়।
২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষণার আগ পর্যন্ত মার্স ওয়ান প্রজেক্টের দূত হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন কার্সন।