তুষারশুভ্র বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মাঝে বিস্তৃত এক পর্বতশৃঙ্গ। পাথরের চূড়া এমনভাবে সাজানো, উপর থেকে দেখলে মনে হয় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে কোনো নারী। ঘুমন্ত নারীদেহের নয়নাভিরাম এ পাহাড় পরিচিতি পেয়েছে ‘স্লিপিং লেডি মাউন্টেন’ নামে।
গুঞ্জন রটেছিল, অদেখা পাহাড়টি আলাস্কা, তিব্বত কিংবা মেক্সিকোর কোথাও অবস্থিত। ড্রোন দিয়ে তোলা হয়েছে ছবিটি।
কিন্তু ফ্যাক্ট চেকে বেরিয়ে এসেছে, এমন কোনো পাহাড়ের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। ফরাসি চিত্রশিল্পী জ্যঁ-মিশেল বিহোরেলের আঁকা ছবিটি ত্রিমাত্রিক ডিজিটাল সৃষ্টি।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুমন্ত নারীর আদলে পাহাড়ের চূড়ার ছবিটি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও পিন্টারেস্টে দেখেছেন কোটি কোটি মানুষ।
ক্যাপশনগুলোতে পাহাড়ের অবস্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তিব্বত, মেক্সিকো, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান বা আলাস্কা।
ছবিসহ কয়েকটি পোস্টের প্রতিটি শুধু শেয়ারই হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি বার।
সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা জায়গাটির নাম দিয়েছে ‘স্লিপিং লেডি মাউন্টেন’ বলে।
কেউ বলেছেন, এটি আলাস্কার মাউন্ট সাস্টিনা। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় রূপকথার এক গল্পের ওপর ভিত্তি করে এর নাম ‘ঘুমন্ত নারী’।
কেউ আবার বলছেন, এটি মেক্সিকোর ইজতাচ্চিহুয়াতি আগ্নেয়গিরি। পূর্ব বা পশ্চিম দিক থেকে দেখলে এই আগ্নেয় পর্বতটির সঙ্গে বাস্তবেই অনেকে শুয়ে থাকা নারীদেহের মিল খুঁজে পান। অ্যাজটেক পুরাণে এর নামও ‘ঘুমন্ত নারী’।
কিন্তু এসব পাহাড়ের কোনোটিই উপর থেকে দেখতে এমন নয়, যেমনটা দেখা যাচ্ছে ভাইরাল ছবিটিতে।
গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চে এ ছবির মাধ্যমে বিভিন্ন লিংকে ঢুকে দেখা গেছে, সব মন্তব্য বা প্রকাশনাতেই বলা হয়েছে যে স্লিপিং লেডি মাউন্টেন কোনো প্রাকৃতিক সৃষ্টি নয়; এটি ডিজিটাল সৃষ্টি।
মানুষের মধ্যে ভীষণ কৌতূহল জাগানো ছবিটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০২০ সালের ৯ মার্চ। ফরাসি শিল্পী জ্যঁ-মিশেল নিজের ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম পেজে ডিজিটাল ভাস্কর্যটির নাম দিয়েছিলেন ‘উইন্টার স্লিপ’ বা ‘শীতের ঘুম’।
এই শিল্পীর ওয়েবসাইট এবং ডিজিটাল ছবির আরও কিছু প্ল্যাটফর্মে ছবিটি আরও নিখুঁতভাবে পাওয়া যাবে।
জ্যঁ-মিশেলের ইউটিউব চ্যানেলে ‘উইন্টার স্লিপ’-এর স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিও দেখে মনে হয় যেন ছবিটি ড্রোন দিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু আসলে ছবিটি পুরোপুরি কম্পিউটারে তৈরি করা।
২০১৬ সাল থেকে বিশেষায়িত ডিজিটাল শিল্পের ওপর কাজ করছেন মিশেল। ছবিতে চোখের দেখায় অবিকল বাস্তব রূপ দিতে ভীষণ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়ের (বিশেষ আলো, বস্তুর আয়তন ও মাধ্যমের) ওপর জোর দেন তিনি।
অনলাইনে ‘উইন্টার স্লিপ’বিষয়ক একটি নিবন্ধের নিচে করা মন্তব্যে মিশেল জানান, প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ স্ক্র্যাচের মাধ্যমে ‘থ্রি-ডি স্ক্যান, হ্যান্ড স্কাল্পটিং ও প্রসিডিউরাল টেরাইন জেনারেশন’-এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ছবিটি তৈরি করেছেন তিনি।
‘উইন্টার স্লিপ’ তৈরির কয়েক বছর আগে ‘স্লিপিং উইম্যান অন দ্য সারফেস অফ মার্স’ বা ‘মঙ্গলপৃষ্ঠে ঘুমন্ত নারী’ নামেও একটি ছবি তৈরি করেছিলেন মিশেল। রূপকভাবে ‘গ্রহের বিশ্রাম’ বোঝাতে ওই ছবিটি তৈরি করেন তিনি।
ভাইরাল হওয়া ‘উইন্টার স্লিপ’ও ওই একই ধারণার ফসল।
মিশেল বলেন, ‘তুষারময় ছবিটির মাধ্যমেও আমি গ্রহের বিশ্রামের বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফ্রান্সে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রথম যখন লকডাউন দেয়া হয়, ঠিক সে সময় ছবিটি প্রকাশ করি। তখন পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেমে গিয়েছিল।
‘এসব ভেবে যে আমি ছবিটি তৈরি করেছি, তা নয়। কিন্তু ছবিটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে ঘটনাগুলো মিলে গেছে। মানুষের যে বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার, সেটিরও প্রতিফলন আছে এ ছবিতে।’
মিশেল আরও বলেন, ‘মানুষ প্রথমে এটি কাজাখস্তানের পাহাড় বলে ছবিটি ভাইরাল করলো। এরপর আরেক দল বলল, এই পাহাড় মেক্সিকোতে। তারপর আলাস্কার একটি পর্বতের সঙ্গেও এর তুলনা হলো। কিছু টেলিভিশন চ্যানেল আর সংবাদপত্র এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।
‘এখনও আমার নিজের ইনস্টাগ্রাম পেইজে অনেক মানুষ পাহাড়টির সম্ভাব্য অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করেন।
‘শেষ পর্যন্ত যে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে হলেও ছবিটি তারা পছন্দ করেছেন, এতে শিল্পের নতুন একটি মাধ্যম বিকশিত হয়েছে, মানুষ এ মাধ্যম সম্পর্কে জানতে শুরু করেছেন।’
ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় দুই মাস আগে এই শিল্পকর্মের কয়েকটি ছাপা সংস্করণ বিক্রি করবেন বলে ফেসবুকে ঘোষণা দেন মিশেল।
‘উইন্টার স্লিপ’-এর পর আরেকটি মানবরূপী শিল্পকর্ম তৈরি করছেন ফরাসি এই শিল্পী। তার পরবর্তী শিল্পকর্মটিতে দেখা যাবে অগ্ন্যুৎপাতে বেরিয়ে আসা উত্তপ্ত লাভার স্রোতে তৈরি নারীদেহের একটি আদল।