আদালতের কাঠগড়ায় ‘রক্তমাখা পোশাক’ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক আসামির ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ওই আসামির পাশে ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকেও দেখা যায়। ফেসবুকে বেশ কিছু পোস্টে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দুজনকেই ‘ছাত্রনেতা’ দাবি করে ‘রক্তমাখা পোশাক’কে তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রমাণ হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ওই দুই জনের বিষয়ে পুলিশসহ আদালত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার মামলায় আখতার হোসেনকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানিয়ে গত বুধবার আদালতে তোলে পুলিশ।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের বিচারক মামুনুর রশীদ এ আবেদনের শুনানি শেষে আখতারকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন।
ওই আবেদনের শুনানির সময় কাঠগড়ায় আখতারের পাশে দাঁড়ানো আরেক তরুণ অন্য একটি মামলার আসামি বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ ও আদালত সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, আখতারের পাশে দাঁড়ানো তরুণের নাম শাহারুম ইসলাম রিফাত। ফুলবাড়িয়া এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় তিনি গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন। এ কারণে তার আঙুলে ব্যান্ডেজ ও ট্রাউজার্সে রক্ত লেগে ছিল।
ফেসবুকে বেশ কিছু পোস্টে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো শাহারুমকেও ‘ছাত্রনেতা’ দাবি করা হয়েছে
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, শাহবাগ থানার ছিনতাই মামলার আসামি শাহারুম আলম রিফাত রাস্তায় গণপিটুনির সময় নিজের কাছে থাকা ছুরি দিয়ে নিজের আঙুল কেটে ফেলেন। তবে আঘাত গুরুতর না হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর পুলিশ তাকে বুধবার আদালতে তোলে। শাহারুম পুলিশের হেফাজতে নিজেই হেঁটে সেদিন কাঠগড়ায় ওঠেন বলেও দাবি করেন জাফর হোসেন।
তিনি বলেন, ‘কোনো আসামির রিমান্ড আবেদনকালে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। কোনো আসামিকে কাঠগড়ায় তোলা বা না তোলার নির্দেশের বিষয়টি পুরোপুরি ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার।
শাহারুমের বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলার বাদি শাহবাগ থানার আওতাধীন বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের সামনে ঘোরাঘুরির সময় পুলিশকে দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন শাহারুম। এ সময় ব্যবসায়ীরা তাকে ধরে ফেলে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় শাহারুম নিজের কাছে থাকা ছুরিতে হাতের আঙুল কাটে। ছুরি দেখে ব্যবসায়ীরা আরও উত্তেজিত হয়ে তাকে পিটুনি দেয়।’
শাহারুমের সঙ্গে রাতুল নামে আরেক তরুণ ছিলেন, তবে তিনি পালিয়ে যান বলে জানান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সহায়তায় আমরা শাহারুমকে ছুরিসহ আটক করে থানায় নিয়ে আসি। রাতেই তার বিরুদ্ধে ছিনতাই মামলা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতুলকে ধরার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হলেও তাকে ধরতে পারিনি।’
ছিনতাইয়ের অভিযোগে শাহারুম ইসলাম রিফাতের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শাহবাগ থানায়
শাহারুমের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। তিনি ঢাকায় বংশাল এলাকার আনন্দবাজারের সেক্রেটারিয়েট রোডের একটি বাড়িতে থাকেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ পরিদর্শক ফারুক মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করে ১৪ এপ্রিল রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে কোর্টে পাঠানো হয় শাহারুমকে। তবে করোনার কারণে সেদিন শেষপর্যন্ত রিমান্ড আবেদনের শুনানি হয়নি। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই শুনানি হবে। তাকে আপাতত কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।’
আসামির আঙুল কাটা থেকে শুরু করে তার চিকিৎসার সব বিষয় লিখিতভাবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
রক্তাক্ত পোশাকে শাহারুমকে কেন আদালতে পাঠানো হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আসামিকে যে অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেই অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। এখানে তার কোনো কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন তো দেখি না। যেভাবে পেয়েছি, সেভাবেই পাঠিয়েছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাস্তায় চোর, ছিনতাইকারী বা যে কোনো ধরনের অপরাধী গণপিটুনির শিকার হলে পুলিশ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উদ্ধার করে। পরে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আদালতে হাজির করা হয়।
‘অনেক সময় ছেঁড়াফাটা পোশাক বা রক্তমাখা পোশাক পরা অবস্থাতেই আসামিদের কাঠগড়ায় নিয়ে যেতে হয়। আসামিদের পোশাক বদলের সময় ও সুযোগ থাকে না। এ বিষয়ে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।’
তিনি বলেন, ‘তবে অনেক সময় থানা বা পুলিশের হেফাজত থেকে কোনো আসামিকে কোর্ট হাজতে আনার পর শরীর থেকে রক্ত বের হলে বা দৃশ্যমান জখম অথবা যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা গোচরীভূত হলে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তার পরামর্শে কোর্টের হাজতেই আসামির পোশাক বদল করা হয়ে থাকে। তারপর এজলাসের কাঠগড়ায় হাজির করানো হয়।’
অন্যদিকে, কোর্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানান, যেসব মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তার আগাম কোনো নির্দেশনা থাকে না, সেসব মামলার আসামিদের বাহ্যিক, শারীরিক কিংবা মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে তারা যত্নশীল থাকেন না। কাজেই কার পোশাকে কী লেগে আছে সেটা অনেক সময় লক্ষ্য করা হয়ে ওঠে না।
আখতারকে নির্যাতনের অভিযোগে কর্তৃপক্ষ কী বলছে
ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে নির্যাতন ও হাতে দড়ি বেঁধে কাঠগড়ায় তোলার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী
আখতারকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করছে পুলিশ। ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শাহবাগ থানার একটি মামলায় ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা আখতারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তার ওপর কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে রাস্তায় লোকজনের হাতে পিটুনির শিকার, গ্রেপ্তারকৃত এক ছিনতাইকারীর সঙ্গে একই দিন একই সময়ে কোর্টের কাঠগড়ায় তার দাঁড়ানোর ঘটনাটিকে কেউ কেউ ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করছেন।’
মামলাটির তদন্ত করছেন ডিবির রমনা জোনাল টিমের উপ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম খান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আখতারকে আমরা গতকালই (বুধবার) মাত্র রিমান্ডে পেয়েছি। এর আগে গ্রেপ্তারের পরেও তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
হাতে দড়ি বেঁধে আদালতে তোলার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন দুই মামলার আসামিকে (আখতার ও শাহারুম) এক সঙ্গে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। তাদের কারো হাতই দড়ি বাঁধা ছিল না। তবে দুজনেরই একটি হাতকড়া ছিল এবং সেই হাতকড়া দড়িতে বাঁধা ছিল। আদালতে একাধিক আসামিকে একসঙ্গে যখন নেয়া হয় তখন এ ধরনের ব্যবস্থা খুব সাধারণ ঘটনা।’
পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়ার মামলায় আখতার হোসেনকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন আইনজীবী শিশির মনির। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, আখতারকে নির্যাতনের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি।