কোভিড ১৯ মোকাবিলায় নাগরিকদের ঘরের ভেতরে থাকার আহ্বান জানিয়ে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনি একটি আবেগময় ভাষণ দিয়েছেন, এমন একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এ গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়া এই পোস্টে দাবি করা হয়, মুসেভনি জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে কোভিড ১৯ এর সংক্রমণকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাংলায় অনূদিত এই ‘ভাষণে’ মুসেভেনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার অনেক কাজ আছে— পুরো দুনিয়াটা দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁর। তিনি শুধুমাত্র উগান্ডার বোকা মানুষদের দেখাশুনার জন্যে এখানে বসে নেই।
‘যুদ্ধাবস্থায় কেউ কাউকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে বলে না। আপনি ঘরে থাকলে সেটা আপনার নিজের চয়েস। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার যদি একটা বেজমেন্টও থাকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্যে তাহলে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা যতদিন না শেষ হয় ততদিন আপনি সেখানেই লুকিয়ে থাকবেন।’
এই পোস্টে মুসেভেনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘যুদ্ধের সময় স্বাধীনতা খর্ব হয়। আপনি ইচ্ছে করেই স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেন শুধুমাত্র নিজের বেঁচে থাকার জন্যে। এ সময় আপনি ক্ষুধার জন্যে কারো কাছে নালিশ করেন না। এ সময় আপনি কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে, বেঁচে থাকলে খেতে পারবেন।
‘যুদ্ধের সময় আপনি আপনার ব্যবসা খোলা রাখার জন্যে তর্ক করেন না। আপনি আপনার দোকান বন্ধ করে দেন (তবে সেই সময়টুকু যদি আপনি পান), এবং জীবন বাঁচানোর জন্যে দৌড়ে পালান। আপনি সারাক্ষণ প্রার্থনা করেন যেন যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় এবং আপনি আপনার ব্যবসাটা আবার চালু করতে পারেন, যদি না আপনার দোকানের সমস্ত মালপত্র লুট হয়ে যায় বা মর্টারের আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।’
বাংলাভাষী ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেকে এই পোস্টটি শেয়ার করেছেন
করোনার সময় সব কিছু বন্ধ রাখার বিষয়ে মুসেভেনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘যুদ্ধের সময় একটি দিন বেঁচে থাকতে পারলে আপনি সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। এ সময় আপনার সন্তানরা স্কুলে যেতে পারলো না বলে আপনি দু:খ করেন না। আপনি সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন যাতে সরকার আপনার সন্তানদেরকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত না করে এবং তাদের স্কুলমাঠেই (যেটি এখন সেনা ক্যাম্প) তাদেরকে প্রশিক্ষণের জন্যে নিয়ে না যায়।
‘পৃথিবীতে এখন একটি যুদ্ধ চলছে — এমন একটি যুদ্ধ যেখানে বন্দুক ও গুলির ব্যবহার নেই, যে যুদ্ধের কোনো সীমানা নেই, যে যুদ্ধ কোনো সীমানা নিয়েও বাধে নাই, কোনো পবিত্র ভূমি নিয়েও না। এই যুদ্ধে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিও নেই; এ যুদ্ধ থামানোর জন্যে কোনো জাতিসংঘও নেই।
‘এই যুদ্ধের সৈন্যদের কোনোপ্রকার দয়ামায়া নেই। শিশু, মহিলা বা প্রার্থনার স্থান, কোনোকিছুর প্রতিই এই সৈন্যদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। কোনো শাসকগোষ্ঠীকে পরিবর্তন করার ইচ্ছা এদের নেই। মাটির নিচের মূল্যবান খনিজসম্পদ লুন্ঠনের কোনো খায়েশ এদের নেই। ধর্ম, গোষ্ঠী বা আদর্শগত প্রভুত্ব বিস্তারের কোনো লিপ্সাও এদের নেই। ’
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে ফেসবুক পোস্টে মুসেভেনিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘শুধু একটাই খায়েশ এদের, আর তা হলো মৃত্যু ঘটানো, মৃতদের আত্মা নিয়ে তাদের ঘরে তোলা, যেমন করে কৃষক ফসল ঘরে তোলেন। এরা ততক্ষণ পর্যন্তু তাদের এ মহোৎসবে মেতে থাকবে যতক্ষণ না পুরো পৃথিবীটা একটা মৃত্যুকূপে পরিণত হবে। এদের উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষমতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। কোনোরকম যুদ্ধাস্ত্র ছাড়াই পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে এরা ঘাঁটি গেড়েছে। এদের গতিবিধি বা আক্রমণ কোনো রীতিনীতি বা প্রটোকল দ্বারা আবদ্ধ নয়। এ যুদ্ধের সৈনিকরাই হচ্ছে করোনা ভাইরাস যাকে আমরা সংক্ষেপে কোভিড ১৯ বলি।
‘তবে আশার কথা হচ্ছে, এই সৈন্যদেরও একটা দুর্বলতা আছে এবং এদেরকে হারানো সম্ভব। এর জন্যে যা দরকার তা হলো — আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, নিয়মনুবর্তিতা এবং ধৈর্য। কোভিড ১৯ সামাজিক এবং শারিরীক দূরত্বে টিকে থাকতে পারে না। এটা সংস্পর্শ/সংঘর্ষকে পছন্দ করে। এটি আমাদের সামাজিক বা শারিরীক দূরত্বের কাছে পরাজয় বরণ করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কাছেও হার মানে। আপনার হাত জীবাণুমুক্ত থাকলে এরা একেবারেই অসহায়।
‘আসুন আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং কোভিড ১৯-কে পরাজিত করি। কষ্ট হলেও একটু ধৈর্যধারণ করি। বেশিদিন লাগবে না আমরা আবার স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারব, আমাদের মন যা চায় তা করতে পারব! এই জরুরি মুহূর্তে আমরা জরুরি সেবা প্রদানে রত থাকি এবং অন্যদেরকে ভালোবাসি!’
ফ্যাক্ট চেক
উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনি জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে এসব বলেছেন বলে দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টে। তবে ওই ভাষণের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যসূত্র নেই। প্রতিটি পোস্টের শেষে ‘সংগৃহিত’ শব্দের উল্লেখ আছে।
বাংলাভাষী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা মূল পোস্টের লেখা কপি করে তাদের নিজস্ব টাইমলাইনে শেয়ার করছেন।
এই ‘ভাষণ’ এর সত্যতা যাচাইয়ে উগান্ডাসহ আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের গত কয়েক মাসের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেছে নিউজবাংলা। এতে দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের ১৮ মার্চ প্রথম দফায় দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি। পরে কয়েক দফা বাড়িয়ে ২ জুন পর্যন্ত ছিল এ অবস্থা। তবে এরপর আর্থিক বিপর্যয় সামাল দিতে শিথিল করা হয় বিধিনিষেধ। এমনকি উগান্ডার অর্থনীতির অন্যতম উৎস পর্যটন খাতেও বিধিনিষেধ এখন অনেকটাই শিথিল।
উগান্ডার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এখন লকডাউনের কোনো নির্দেশনা নেই
উগান্ডার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ৭৫১ জন, মারা গেছেন ৩৩৫ জন। উগান্ডার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কোনো নির্দেশনাতেও নাগরিকদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়নি।
তাহলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনির এই ভাষণটি কবেকার? অথবা আদৌ কি তিনি এ ধরনের কোনো ভাষণ দিয়েছেন?
এর অনুসন্ধানে প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনির নামেই একটি ওয়েবসাইটের খোঁজ পেয়েছে নিউজবাংলা। yowerikmuseveni.com নামের ওই ওয়েবসাইটে ১৯৮৬ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা মুসেভেনি ও তার দল দ্য ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্টের (এনআরএম) দৈনন্দিন সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সংকলন রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনির নামে আছে একটি ওয়েবসাইট
এই ওয়েবসাইটে জাতির উদ্দেশে মুসেভেনির দেয়া ভাষণসহ সব ধরনের বক্তব্যও রয়েছে। এতে দেখা গেছে, উগান্ডায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোভিড ১৯ ইস্যুতে মোট ১৩টি বক্তব্য ও ভাষণ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। এরপর সুনির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে তিনি আর কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বা ভাষণ দেননি।
কোভিড ১৯ নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি জাতির উদ্দেশে এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি ভাষণ দিয়েছেন। এই ভাষণের তারিখগুলো হলো, গত বছরের ৪ জুন, ২০ মে, ১৪ এপ্রিল, ২৫ মার্চ ও ১৮ মার্চ। এর বাইরে গত বছরের ২৭ আগস্ট তিনি জাতির উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখেন। এছাড়া, করোনাভাইরাস ইস্যুতে বিভিন্ন গাইডলাইন তুলে ধরে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন সাত বার।
কোভিড ১৯ নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির মোট ১৩টি ভাষণ ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছে নিউজবাংলা। তবে এর কোনোটিতেই বাংলাভাষী ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যে কথিত ভাষণের অনুবাদ দিয়েছেন, সে ধরনের কোনো কথা নেই।
প্রেসিডেন্ট ইওয়েরি কাগুতা মুসেভেনির নামের এই ওয়েবসাইটে তার সব ভাষণ ও বক্তব্য সংকলিত আছে
ইদি আমিনকে উৎখাত করে উগান্ডার ক্ষমতায় আসা মুসেভেনি গত বছরের ৪ মে একটি বক্তব্য দেন, যার সঙ্গে ফেসবুকে ভাইরাল কথিত ভাষণের সামান্য কিছু মিল রয়েছে। মুসেভেনি সেই বক্তব্যে বলেন, ‘আমি বিষয়টি বুঝি কারণ আমি আমিনবিরোধী (ইদি আমিন) যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছি। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়েছি। ১৯৮৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান আর বিদ্রোহীদের উৎখাতের লড়াইয়েও অংশ নিয়েছি।’
মুসেভেনি বলেন, ‘২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে বাড়ি না ফিরে বাজারেই আশ্রয় নেয়া বিক্রেতা নারীদের ছবিটি দেখেছি আমি। আমার মনে পড়ে গেছে আশির দশকের যুদ্ধের সময় ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বন-জঙ্গল আর মরু অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে থাকা লুয়েরো ট্রায়াঙ্গলের ১০ লাখ অসহায় মানুষের কথা। ১৯৮৬ সালের যুদ্ধ জয়ের আগ পর্যন্ত নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারেননি তারা। লুয়েরো ট্রায়াঙ্গলের যুদ্ধের সেই স্মৃতি, সেই আত্মত্যাগ আর স্বেচ্ছাসেবার উদ্দীপনাকে আবারও জাগিয়ে তোলার জন্য, সুযোগসন্ধানী ও স্বার্থপরতার সংস্কৃতিকে লজ্জায় ফেলে দেয়ার জন্য স্বাগত জানাচ্ছি।’
প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি গত বছরের ৪ মে এই বক্তব্যটি দিয়েছেন
প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে বলতে চাই, এনআরএম (ন্যাশনাল রেসিস্ট্যান্স মুভমেন্ট) সব সময় বুদ্ধি দিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। আমরা কখনো আত্মঘাতী যুদ্ধ করি না। আত্মঘাতী যুদ্ধ এক ধরনের রাজনৈতিক হঠকারিতা। যে কোনো যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সে জয় যেন দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাও নিশ্চিত করতে হয়। আর সে জন্য লড়াই হতে হয় কৌশলী।
‘একই সূত্র করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মহামারি স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আমাদের কৌশল হলো ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করা। আর সংক্রমণ এড়াতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে সবচেয়ে আগে। শুধু এ লক্ষ্যেই ৩৫টি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে এই সংক্রমণ এড়ানোর লক্ষ্য অর্জন যেন আত্মঘাতী পদক্ষেপ হয়ে না দাঁড়ায়, তাও খেয়াল রাখা দরকার। গণহারে সংক্রমণ আর আত্মঘাতী হওয়া এক সঙ্গে ঠেকানো কীভাবে সম্ভব?’
ওই বক্তব্যের বাকি অংশে লকডাউন মেনে চলার আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট মুসেভেনি। আর লকডাউন শিথিলের পর গত বছরের ৪ জুন এ বিষয়ে সবশেষ তিনি যে ভাষণ দেন, সেখানে বেশিরভাগ অংশ জুড়েই ছিল বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আহ্বান।