চার নারী একটি খোলা জিপে বসে আছেন। একজন স্টিয়ারিং ধরে চালকের আসনে, বাকি তিনজনের হাতে বন্দুক। মধ্যবয়সী এই চার নারীর পুরোনো দিনে তোলা ছবির পাশাপাশি ঠিক একই ভঙ্গীতে সাম্প্রতিক সময়ে তোলা আরও একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়েছে, এই চার নারী পরস্পরের বান্ধবী এবং তারা চারজনই মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তোলা হয় প্রথম ছবিটি, আর পরের ছবিটি স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তোলা হয়েছে একই ভঙ্গীতে।
ছবিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করেছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে, পুরোনো ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বলে প্রচার করা হলেও এর কোনো সত্যতা নেই। সম্পূর্ণ পারিবারিক একটি ছবিকে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে।
নিউজবাংলা কথা বলেছে ওই চার নারীর স্বজনদের সঙ্গে। এতে জানা গেছে, গাড়িতে থাকা চারজনের মধ্যে স্টিয়ারিং ধরা নারীর নাম আয়েশা আহমেদ। আয়েশার ডান পাশে বসা নারী রোকেয়া আহমেদ, আর পেছনের সিটে বসা দুজনের নাম রাশিদা আহমেদ ও শাহানারা আহমেদ।
এই চার নারীই ১৯৬০ এর দশকে ঢাকার এক বনেদি পরিবারের সদস্য ছিলেন। প্রথম ছবিটি তোলা হয় ১৯৬০ এর দশকের একদম শুরুর দিকে খুলনায়, আর একই আঙ্গিকে ২০১৭ সালে ঢাকায় তোলা হয় পরের ছবিটি।
১৯৬০ এর দশকে তোলা হয় ওপরের ছবিটি, নিচেরটি তোলা ২০১৭ সালেরোকেয়া আহমেদের পুত্রবধূ রিফাত আহমেদ কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে। রাজধানীর সিদ্দিকস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারম্যান রিফাত আহমেদ জানান, গাড়িতে বসা চার নারীর স্বামী ও ভাইয়েরা ষাটের দশকের শুরুতে খুলনা অঞ্চলে শিকার করতে গিয়েছিলেন। শিকার শেষে তারা ফেরার পর রান্নাবান্না শেষে এই চার নারী গাড়িটিতে বসে ছবিটি তুলেছিলেন।
পুরনো ছবিটি তোলেন রিফাত আহমেদের শ্বশুর তখনকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও সৌখিন ফটোগ্রাফার আলাউদ্দিন আহমেদ। আর ২০১৭ সালে আবার ওই চার জনের ছবি তোলেন স্বামী আমিন উদ্দিন আহমেদ।
একই গাড়িতে অন্য ভঙ্গিতে চার নারীর ছবিরিফাত আহমেদ নিউজবাংলাকে জানান, তার শ্বশুর আলাউদ্দিন আহমেদের বাবা ও তার দুই বন্ধু দেশভাগের পর ভারতে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাদের আদি বাড়ি মানিকগঞ্জে। দেশে ফেরার পর তারা নৌপরিবহন ব্যবসা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাদের পাক ওয়াটার ওয়েজ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার যার নাম হয় বেঙ্গল ওয়াটার ওয়েজ। পরে সেই ব্যবসায় আলাউদ্দিন আহমেদ ও তার ভাইয়েরাও যুক্ত হন।
অবসরে আলাউদ্দিন আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে শিকারে যেতেন। তেমনিভাবে ১৯৬১/৬২ সালের দিকে তারা শিকারে গিয়েছিলেন খুলনায়। আলাউদ্দিন আহমেদ শিকার শেষে ফিরে আসার পর স্ত্রী, দুই ভাবি ও বোনকে একটি গাড়িতে বসিয়ে বন্দুক হাতে ছবি তুলে দেন।
এরপর ২০১৭ সালে এই চারজনকে নিয়ে একই ভঙ্গিমায় ছবি তোলা হয়। তখন উপলক্ষ্য ছিল রিফাত আহমেদের বড় ছেলে রিনান আহমেদের বিয়ে। রিফাত আহমেদ নিউজবাংলাকে জানান, বিয়ে উপলক্ষে পারিবারিক পুরনো ছবিগুলো রিপ্রিন্ট করে সাজানো হয়। বিয়েতে দেশ ও বিদেশের আত্মীয়রা উপস্থিত হয়েছিলেন। বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাস করা আয়েশাও বিয়েতে এসেছিলেন।
রিফাত আহমেদ বলেন, ‘বিয়ের পরপরই, সবগুলো মানুষ যেহেতু আছে, তাদের নিয়ে আবার ছবিটি উঠানো হয। আগের বন্দুকগুলো না থাকলেও নতুন ছবির বন্দুকগুলো ছিল কাছাকাছি। তবে গাড়িটা একই।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার উইলিস মডেলের গাড়িটি এখনও আমিন উদ্দিন আহমেদের পরিবারের সংগ্রহে রয়েছে।
আলোচিত চার নারীর প্রথম ছবিটি তোলেন তখনকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও সৌখিন ফটোগ্রাফার আলাউদ্দিন আহমেদ।পুরনো ও নতুন ছবি দুটি একসঙ্গে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন আমিন উদ্দিন আহমেদের বড় ছেলে রিনান আহমেদ। কয়েক বছর আগে তিনি ছবি দুটি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করেছিলেন। তবে সেই ভিত্তিহীন লেবেলে ভাইরাল হয় এ বছর।
মিথ্যে তথ্য দিয়ে ছবিটি প্রচারে অস্বস্তিতি রিফাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে ছবিটি প্রচার হচ্ছে দেখে আমাদের খারাপ লাগছে। ছবিটিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে রিলেট করা হচ্ছে। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধকে মিথ্যা কিছু দিয়ে চিত্রায়িত করতে চাই না। ’
এ ছবির চার নারীর মধ্যে রোকেয়া আহমেদ ও রাশিদা আহমেদ মারা গেছেন করোনা মহামারির মধ্যে। বাকি দুজনের একজন দেশে ও অপরজন ইংল্যান্ডে আছেন।