হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে এক যুবকের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দু গ্রামে বুধবার সকালে হামলা হয়। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এরই মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি, যেখানে অভিযোগ করা হয়েছে, এই হামলায় উসকানি ও নেতৃত্ব দিয়েছেন শাল্লার উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ওই ছবিতে চিহ্নিত উপজেলা চেয়ারম্যানের ভূমিকা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নিউজবাংলা।
কী আছে সেই ফেসবুক পোস্টে
দেখা গেছে, ছবিটি প্রথম ফেসবুকে পোস্ট করেন হাসান সরদার নামের এক ব্যক্তি।
তিনি লেখেন, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় এক হিন্দু পরিবারের উপর হামলা চালিয়ে যে নির্যাতন, ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে এবং ওই পরিবারের যে ছেলেটিকে কেন্দ্র করে হেফাজত ইসলামের লোকজন (প্রথমদিকে বলা হয়েছিল) ওই হামলায় ছিলো, তাতে সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে এবং পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ঐ এলাকার ত্রিশহাজার (অনুমেয়) লোক যারা হামলায় ছিলো, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে উক্ত উপজেলার চেয়ারম্যান। আরও মজাদার কাহিনী আছে, তিনি হেফাজত ইসলামের কেউ না! উপজেলা আম্লিগের সাধারণ সম্পাদকও বটে এবং সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে নিজে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
এই পোস্টে সংযুক্ত কোলাজ করা ছবিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি হ্যান্ডমাইকে কিছু বলছেন, তার পাশে কয়েকজন দাঁড়ানো এবং তাদের ঘিরে আছে লাঠি হাতে বেশ কিছু মানুষ। মাইক হাতে দাঁড়ানো ব্যক্তির পাশের একজনকে তীর চিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। তীর চিহ্নিত ওই ব্যক্তিই হলেন শাল্লার উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ছবির নিচের অংশে তার উপজেলার ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট দিয়ে চেয়ারম্যানের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসান সরদার নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী পোস্টটি ক্যাফেটেরিয়া নামে একটি পাবলিক গ্রুপেও শেয়ার করেন। পরে সেটি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ফ্যাক্ট চেক
নিউজবাংলা কথা বলেছে অভিযুক্ত সেই উপজেলা চেয়ারম্যান, পাশে মাইক হাতে দাঁড়ানো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ঘটনাস্থলে উপস্থিত বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে। তাদের সবার বক্তব্য, পোস্টটিতে তোলা অভিযোগ ভিত্তিহীন।
শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রামের ও বাজারের মানুষজন সত্যিটা জানে। তিনি (হাসান সরদার) কে সেটাও জানি না। ওখানে মাইক নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তেজিত লোকজনকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
‘পরে আমিও মাইক হাতে নিয়ে তাদের বুঝিয়েছি এমন কাজ করা ঠিক না, আপনারা শান্ত হোন। কিন্তু এখন মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে কেউ আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে।’
শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ছবি: নিউজবাংলা
ইউএনও আল-মুক্তাদির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি শান্ত করার জন্যই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম এবং যাদের সাথে আমরা কথা বলেছি তারা বলেছেন তারা কোনো বিশৃঙ্খলা করবেন না, ফিরে যাবেন। কিন্তু হঠাৎ অন্য দিক থেকে এসে কয়েক শ মানুষ ওই গ্রামে হামলা চালায়।
‘আমরা কেন তাদের ওপর হামলা চালাতে বলব? উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহোদয়ও এমন কোনো কথা বলেননি।’
শাল্লার স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকালে দিরাই উপজেলার সারমঙ্গল ইউনিয়নের কাশিপুর, নাচনী ও নাচনী চন্ডিপুর থেকে দল বেঁধে মানুষ আসতে দেখে তারা পুলিশকে বিষয়টি জানান। পুলিশের সঙ্গে ইউএনও ও চেয়ারম্যানও ধারনবাজার এলাকায় উপস্থিত হন। তারা হ্যান্ডমাইকে সবাইকে শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
বাজারের দিকে আসতে থাকা মিছিলটি তখন শান্ত হলেও অন্যদিক থেকে আরেকটি দল গিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়। ধারনবাজার থেকে একটি বাঁধ পার হয়ে পুলিশ সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ধারনবাজার এলাকার ব্যবসায়ী কবিন্দ্র দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হিদিন (সেদিন) সকালে নাচনী, কাশিপুর গ্রামের মানুষরা লাঠি-দা-বাঁশ নিয়া বাজারের দিকে আইলে পুলিশ তারারে (তাদের) বাধা দেয়। শাল্লার ইউএনও স্যার আর চেয়ারম্যান সাহেব তাগো শান্ত করার লাগি বারবার অনুরোধ করোইন (করেন)। তারার (তাদের) কথা এরা বুঝলেও অন্যদিক থাকি (থেকে) আইয়া একপক্ষ হামলা চালায়। তখন পুলিশকে তাগো ধরতে চেয়ারম্যান সাহেব নিজেই কইন (বলেন)।’
ওইদিন সকালে ধারনবাজারে বাজার করতে গিয়েছিলেন নোয়াগাঁও গ্রামের জ্যোৎস্না রানী দাস। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব আমরার পক্ষে আছলা (ছিলেন)। তাইন (তিনি) ইতা (এসব) কিচ্ছু কইছোইন না (বলেননি)। উল্টা তাইন তারারে বুঝাইছোইন যে ইতা না করার লায়। বিষয়টা লইয়া আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মাতমুনে (কথা বলব)।’
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, ‘এমন কথা ভিত্তিহীন। এটা সত্যি না। হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে কেউ এমন বক্তব্য দেয়নি বরং পরিস্থিতি শান্ত করতেই সেখানে সবার যাওয়া। কেউ এটিকে ভিন্নখাতে নিয়ে যেতেই এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে।’