জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণের দিনটি স্মরণে প্রতিবছর ওই দিনে সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশি কূটনৈতিক মিশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
আর সে জন্য ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’-এ ৭ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধান যুক্ত করে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চার দিন পর, ১৫ ফেব্রুয়ারি তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়।
তবে এই গেজেটের একটি অংশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে জোর বিতর্ক। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মদিন অর্থাৎ ঈদে মিলাদুন্নবীতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সরকারি নির্দেশনার বিষয়টি সামনে এনে এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন নেটিজেনরা।
এমনকি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ৭ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্তের খবরের চেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে ঈদে মিলাদুন্নবীতে পতাকা তোলার বিষয়টিতে। ‘ঈদে মিলাদুন্নবীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের প্রজ্ঞাপন’ এমন শিরোনামও এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা এবং কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে পরিষ্কার, ঈদে মিলাদুন্নবীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সরকারি সিদ্ধান্ত এবারই ‘প্রথম’। তবে বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছে নিউজবাংলা।
সরকারি নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ঈদে মিলাদুন্নবীতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত প্রথম আসে ১৯৭৬ সালের ১০ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রায় সাত মাস পর। একই সঙ্গে ওই সংশোধনীতে জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিধান বাতিল করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় পতাকা-সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করা হয়। ‘দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ রুলস, ১৯৭২’ বা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’ শিরোনামের এই বিধিমালায় জাতীয় পতাকার রং, আকার এবং উত্তোলনের নিয়ম সুনির্দিষ্ট করা ছাড়াও সরকারিভাবে পতাকা উত্তোলনের কয়েকটি দিন নির্ধারণ করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় পতাকা-সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করা হয়। ছবি সৌজন্যে: সংগ্রামের নোটবুক
ওই বিধিমালার ৪-এর ১ উপবিধিতে বলা হয়, নিম্নোক্ত দিনগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশি মিশন ও কনস্যুলারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে:
ক) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ, খ) স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, গ) বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর, ঘ) সরকার ঘোষিত অন্য যেকোনো দিবস।
বিধিমালার ৪-এর ২ উপবিধিতে দুটি দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো: ক) শহিদ দিবস ও খ) জাতীয় শোক দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এই বিধিমালায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে এর পরেই বিধিমালায় প্রথম সংশোধনী আসে ১৯৭৬ সালের ১০ মার্চ। এখন পর্যন্ত মোট ছয়বার সংশোধন হয়েছে জাতীয় পতাকা বিধিমালা, তবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’ শিরোনামটি অপরিবর্তিত রয়েছে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতার পালাবদলে ওই বছরের ৬ নভেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখনকার প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। সে সময় অবশ্য পেছন থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
১৯৭৬ সালের ১০ মার্চ তার সময়েই জাতীয় পতাকা বিধিমালায় প্রথম সংশোধনী এনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবীতে সরকারি, বেসরকারি ভবন এবং দেশের বাইরে কূটনৈতিক মিশনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৭৬ সালের ১০ মার্চ জাতীয় পতাকা বিধিমালায় প্রথম সংশোধনী আনা হয়
বিধিমালা সংশোধন করে বিধানটি যুক্ত করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই দিনই প্রকাশ করা হয় প্রজ্ঞাপনের গেজেট। রাষ্ট্রপতির আদেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব এ কে এম মহসিন গেজেটে সই করেন।
এই সংশোধনীতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ পতাকা উত্তোলনের বিধানটি বিলোপ করা হয়। এটি পরে আর কোনো সংশোধনীতেই ফিরিয়ে আনা হয়নি।
প্রথম সংশোধনীর প্রায় ১৬ বছর পর জাতীয় পতাকা বিধিমালায় দ্বিতীয়বার পরিবর্তন আনা হয় ১৯৮৯ সালে। স্বৈরশাসক হিসেবে তখন ক্ষমতায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
১৯৮৯ সালের ১৩ জুন আনা পরিবর্তন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিধি ৩-এর উপবিধি ২-এর নিচে ‘ডিপেন্ডিং অন দ্য সাইজ অব দ্য বিল্ডিং’-এর জায়গায় ‘ডিপেন্ডিং অন দ্য সাইজ অফ দ্য বিল্ডিং অ্যান্ড ইন কেস অফ নেসেসিটি, অ্যা ফ্ল্যাগ অফ বিগার সাইজ মেইন্টেনিং দ্য প্রপোরশন অফ লেংথ অ্যান্ড উইথড মে বি অ্যালাউড বাই গভর্নমেন্ট টু বি ফ্লোন’ বাক্যটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
প্রথম সংশোধনীর প্রায় ১৬ বছর পর জাতীয় পতাকা বিধিমালায় দ্বিতীয়বার পরিবর্তন আনা হয় ১৯৮৯ সালে
অর্থাৎ এই সংশোধনীতে ভবনের আকারের ওপর নির্ভর করে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের অনুপাত বজায় রেখে সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে বড় আকারের পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি অনুমোদন পায়। এরশাদের সময়ে এর বাইরে পতাকা বিধিমালায় তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়নি।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তবে বিএনপির ওই আমলে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’-এ কোনো পরিবর্তন আসেনি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিজয়ী হয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছাড়ার কিছু আগে আগে তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে জাতীয় পতাকা বিধিমালায়।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে জাতীয় পতাকা বিধিমালায়
জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার দিন ১৫ আগস্টকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করে দিনটিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধান যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল বিধিমালায় ‘শহিদ দিবস’ এবং ‘জাতীয় শোক দিবস’ ২১ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধান ছিল। তবে সেখানে শহিদ দিবসের তারিখ উল্লেখ ছিল না।
২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে সেটি সংশোধন করে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস, ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ এবং সরকার ঘোষিত অন্য যেকোনো দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধান যুক্ত করা হয়।
১৯৭২ সালের বিধিমালা অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ছাড়া গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর সুযোগ পেতেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভার পূর্ণ মন্ত্রী, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও কনস্যুলার প্রধানরা।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এর আওতা বাড়িয়ে প্রধান বিচারপতি, চিফ হুইপ, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর বিষয়টি বিধিমালায় যুক্ত করে।
তখন প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার কোনো ব্যক্তি, উপমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদার কোনো ব্যক্তি ঢাকার বাইরে গেলে তাদের গাড়িতেও জাতীয় পতাকা ওড়ানোর বিধান যুক্ত হয়।
ওই বছরের ১ অক্টোবর হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট। দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
ক্ষমতা গ্রহণের বছর না পেরোতেই চতুর্থ দফায় সংশোধনী আসে জাতীয় পতাকা বিধিমালায়। ১৫ আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধানটি নতুন সংশোধনীতে বাদ দেয় বিএনপি সরকার।
২০০২ সালের ৩ আগস্ট জারি প্রজ্ঞাপনে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিএনপি সরকার
২০০২ সালের ৩ আগস্ট এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এমনকি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তও বাতিল করে বিএনপি।
জাতীয় পতাকা বিধিমালা পঞ্চম দফায় সংশোধন হয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এতে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল করা হয়।
২০০৮ সালের ১১ আগস্ট জারি করা ষষ্ঠ সংশোধনী
২০০৮ সালের ১১ আগস্ট তখনকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রজ্ঞাপনটি জারি করেন।
এর প্রায় এক যুগ পর ১১ ফেব্রুয়ারি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২’ ষষ্ঠ দফায় সংশোধন করা হয়েছে।
আর এতে নতুন করে শুধু যুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিন দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ভবন এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি।
এর আগে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেয়া ভাষণের দিনটিকে ‘জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
বিধি ও সেবা অধিশাখা এবং আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব শফিউল আজিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনটিকে (৭ মার্চ) সরকার ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করেছে। ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হওয়ার কারণে ওই দিন কোনো ছুটি থাকছে না। ফলে দিবসটি কীভাবে পালন করা হবে, তা বিবেচনা করেই ওই দিন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার মাইলফলকের একটি দিন ৭ মার্চ। ফলে সেদিন জাতীয় পতাকা উড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক।’