সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে উঠেছে কিটো ডায়েট। ওজন কমাতে বা বাড়তি মেদ ঝরাতে অনেকেই কাজে লাগাচ্ছেন বিশেষ এই ডায়েট পদ্ধতি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে কিটো ডায়েট ব্যবহারকারী এবং তাদের ‘বিফোর’ ও ‘আফটার’ছবির সংখ্যা বাড়ছে দিনে দিনে।
সাম্প্রতিক সময়ে কিটো ডায়েট আবারও আলোচনায় আসে ভারতীয় অভিনেতা মিষ্টি মুখার্জির মৃত্যুতে। কিডনি বিকল হয়ে পড়ায় মৃত্যু হয় ২৭ বছর বয়সী মিষ্টির। তার ডায়েটিশিয়ান জানান প্রায় দুই বছর কিটো ডায়েটে ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে জনপ্রিয় এই ডায়েট পদ্ধতি আবারও তোপের মুখে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিটো ডায়েট ব্যবহারকারীই এর সুফল সম্পর্কে পোস্ট করছেন নিয়মিত। ছবি: ইন্টারনেট।
কিটো ডায়েট কী?
আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকার প্রায় ৯০ শতাংশ হচ্ছে শর্করা (ভাত, রুটি, আলু)। শরীরের মূল জ্বালানি হচ্ছে গ্লুকোজ, যা কার্বোহাইড্রেট সংশ্লেষণ থেকে আসে। কোনো কারণে গ্লুকোজ শেষ হয়ে গেলে বা ঘাটতি দেখা দিলে শরীর কিটোন নামের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে, যেটি সংশ্লেষিত হয় চর্বি থেকে। এটি মূলত অ্যাসিটোন, অ্যাসিট-অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও বিটা হাইড্রক্সি বিউটারেটের সংমিশ্রণ। এই কিটোন ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে বলা হয় কিটোজেনেসিস।
অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীর এই কিটোজেনেসিস প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। কিটো ডায়েটের অংশ হিসেবে একেবারে সীমিত পরিমাণ শর্করা খাওয়ার ফলে শরীর এই প্রক্রিয়া গ্রহণে বাধ্য হয়। ফলে শরীরে জমা চর্বি থেকে সংশ্লেষিত হতে থাকে জ্বালানি কিটোন।
কিটো ডায়েটের মূল উদ্দেশ্য হলো শরীরে শর্করা কম প্রবেশ করানো। সাধারণত কিটো ডায়েটে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। বাড়ানো হয় চর্বি বা আমিষজাতীয় খাবার (মাংস, ডিম, ডাল)। দিনের খাদ্য চাহিদার ৭০ শতাংশ থাকে চর্বি। শর্করা কম থাকায় ২-৩ দিন পরই শরীরে কিটোজেনেসিস শুরু হয়ে যায়।মূলত চিকিৎসকেরা এই ডায়েট বানিয়েছিলেন মৃগী রোগীদের জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার পর মৃগী রোগীদের খিঁচুনি শুরু হয়। তাই তাদের কিটো ডায়েটের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
কিটোর প্রতিক্রিয়া
শরীরে চর্বি কমানোর পাশাপাশি বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কিটো ডায়েটে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো মেডিসিন এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোকে বলেছে 'কিটো ফ্লু'। এতে ডায়েট গ্রহণকারীর পেট খারাপ, মাথা ঘোরানো, দুর্বলতা ও অস্থির মেজাজের উপসর্গ দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিক জার্নাল ল্যানসেটের হিসাবে, কিটো ডায়েট গ্রহণকারীদের মধ্যে ৩০-৫০ শতাংশের কোষ্ঠকাঠিন্য, তলপেটে ব্যথা ও নিয়মিত বমি হতে পারে।
২৫ হাজার হাজার রোগীকে নিয়ে ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ কার্ডিওলজির এক গবেষণায় দেখা যায়, কম শর্করা ডায়েট শরীরের জন্য ক্ষতিকর। শর্করা বেশি গ্রহণকারীদের চেয়ে কম গ্রহণকারীদের যেকোনো রোগে মৃত্যুহার ৩২ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের অসুখ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ৫১, ৫০ ও ৩৫ শতাংশ।
উচ্চ আমিষ ও চর্বির কারণে কিডনিতে পাথরের সমস্যাও তৈরি করতে পারে এটি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের চাইল্ড নিউরোলজি জার্নালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মৃগী রোগের চিকিৎসার জন্য কিটো ডায়েটে থাকা ১৯৫ শিশুর মধ্যে ১৩ জনের পরবর্তী সময়ে কিডনিতে পাথর জমেছে।
ডায়বেটিক রোগীদের জন্য রক্তে সুগারের পরিমাণ বিপজ্জনক হারে কমিয়ে দিতে পারে কিটো। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের ডায়বেটিক মেডিসিন জার্নালের অন্য আরেকটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, কিটো ডায়েট করলে ডায়বেটিস রোগীদের হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
কিটোর প্রতিক্রিয়ায় মানব মস্তিষ্কের অবধারণগত প্রক্রিয়াও ব্যহত হয়। অমনোযোগী হয়ে পড়া, কাজে ভুল হওয়া, মানসিক দক্ষতা হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
কিটো ডায়েট দ্রুত ওজন কমাতে প্রাথমিকভাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি নিরাপদ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।