১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু ও ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লুর সঙ্গে করোনাভাইরাসজনিত রোগে (কোভিড-১৯) মৃত্যুর হার নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। এসব পোস্টে কেউ কেউ দাবি করেছেন, বিশেষজ্ঞরা কোভিডে মৃত্যুর হারকে অতিরঞ্জিত করেছেন।
এমন কিছু পোস্টের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা পোস্টে একটি দাবি হলো, সংক্রমণের প্রথম বছরে সোয়াইন ফ্লুর চেয়ে কোভিডে আক্রান্ত কম ছিল পাঁচ কোটি ৬০ লাখ। ইউএসএ টুডে এ দাবিকে ভুল প্রমাণ করেছে।
অন্য দুটি দাবি হলো, প্রথম দফা সংক্রমণের চেয়ে দ্বিতীয় দফায় বেশি প্রাণঘাতী ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। কিন্তু এ দাবিটিও ইউএসএ টুডের যাচাইয়ে ভুল প্রমাণিত হয়।
উল্লিখিত দাবিটি নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে একটি মিম। চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে পোস্ট হওয়া মিমটি ৫০ হাজারের বেশি বার শেয়ার হয়েছে।
ওই পোস্টদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছ ইউএসএ টুডে। সংবাদমাধ্যমটির জিজ্ঞাসার জবাবে পোস্টকারী আরও কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছেন, স্বাধীনভাবে যেগুলোর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হবে না।
জনপ্রিয় মিমটিতে অভিযোগ করা হয়, স্প্যানিশ ফ্লু ও মৌসুমি ফ্লুর সঙ্গে কোভিড-১৯-এর তুলনা করতে গিয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। মিমটা শুরু হয় '১% কত বড়?' লেখা বাক্য দিয়ে।
পরবর্তী বাক্যগুলোতে প্রতিটি মহামারী ও মৌসুমি ফ্লুর পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্বের জনসংখ্যার বিপরীতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হারের তুলনাও ছিল তাতে।
মিমে বলা হয়, স্প্যানিশ ফ্লুতে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। সে সময় বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৯৫ কোটি। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, সে সময় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫.২৬ শতাংশের মৃত্যু হয় সংক্রমণে। এ পরিসংখ্যানের পর বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশে বলা হয়, 'বিশেষজ্ঞগণ: বেদনাদায়ক ঘটনা!'
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য অনুযায়ী, মিমে উল্লেখ করা মৃত্যুর সংখ্যা সঠিক। তবে গ্লোবাল চেঞ্জ ডাটা ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৮ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৫ কোটি নয়; ছিল ১৮০ কোটি।
সিডিসি প্রকাশিত স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজেসে ২০০৬ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, স্প্যানিশ ফ্লুতে বৈশ্বিক মৃত্যুর হার ছিল ২.৫ শতাংশ, যেটা মিমে উল্লেখিত হারের অর্ধেকেরও কম। ওই নিবন্ধ অনুযায়ী, স্প্যানিশ ফ্লু দুই বছর (১৯১৮ সালের বসন্ত থেকে ১৯২০ সালের বসন্ত পর্যন্ত) স্থায়ী হয়েছিল।
কোভিড-১৯ কি স্প্যানিশ ফ্লুর চেয়ে বেশি মারাত্মক
মিমে বলা হয়, ২০১৮ সালে বিশ্বে ৭৫০ কোটির মতো মানুষের মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ বা ০.০০৯ শতাংশের মৃত্যু হয় মৌসুমি ফ্লুতে। মিম অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা ওই বছরকে 'টিপিক্যাল ইয়ার' বা গতানুগতিক বছর আখ্যা দিয়েছেন।
মিমের এই অংশটি সঠিক। প্রতি বছর বিশ্বে ৩০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ মৌসুমি ফ্লুতে আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, এতে মৃত্যু হয় গড়ে দুই লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষের।
ডব্লিউএইচওর বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাক্টচেক সাইট ফুল ফ্যাক্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, মৌসুমি ফ্লুতে বৈশ্বিক মৃত্যুর হার এক শতাংশের কম।
মিমে কোনো তারিখ উল্লেখ না করে বলা হয়, বিশ্বে ৭৭০ কোটি মানুষের মধ্যে কমপক্ষে চার লাখ ৮৮ হাজার ৭২৯ জনের মৃত্যু হয় কোভিডে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যের বরাত দিয়ে ইউএসএ টুডের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২৮ জুনেই কোভিডে মৃত্যু পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।
২৮ জুলাই পোস্ট হওয়া মিমটির শেষের দিকে বলা হয়, 'বিশ্বের ১ শতাংশ জনসংখ্যা ধরলে এখন মৃত্যু হতো সাত কোটি ৭০ লাখ। এখন কথা হলো, ৫.২৬ শতাংশ যদি বেদনাদায়ক ও .০০৯ শতাংশ বড় কোনো বিষয় না হয়, তাহলে আমরা কি এমন জিনিস করতে যাচ্ছি!'
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, মধ্য আগস্টে কোভিডে মৃত্যু হয় সাত লাখ ৭৬ হাজারের বেশি মানুষের।
কোভিড-১৯ কি স্প্যানিশ ফ্লু বা মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে বেশি প্রাণঘাতী
চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী জেএএমএ নেটওয়ার্ক ওপেনে গত ১৩ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গে কোভিডে মৃত্যুর তুলনা করা হয়। এতে নিউ ইয়র্ক সিটিতে কোভিড-১৯-এর প্রথম সংক্রমণের দুই মাসের মৃত্যুর সঙ্গে স্প্যানিশ ফ্লুর সবচেয়ে প্রাণঘাতী দুই মাসের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়।
গবেষকরা দেখান, স্প্যানিশ ফ্লুর পুরোপুরি সংক্রমণের সময় প্রতি লাখে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলেও এখনো এটি কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনাযোগ্য।
স্প্যানিশ ফ্লু ও কোভিডে শুরুর দিককার মৃত্যুর হার দিয়ে গবেষকরা পার্থক্যটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, ১৯১৮ সালে ফ্লুতে মৃত্যুর চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন নাজুক স্বাস্থ্যবিধি, জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে। বিপরীতে তুলনামূলক উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার পৃথিবীতেও কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুর পর্যায়ে মৃত্যুর হার স্প্যানিশ ফ্লুর সর্বোচ্চ পর্যায়ের মৃত্যুর হারের তুলনায় 'উল্লেখযোগ্য হারে বেশি'।
ইউএসএ টুডের ১৩ আগস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিউ ইয়র্কে চলতি বছরের ১১ মার্চ থেকে ১১ মে পর্যন্ত দুই মাসে কোভিডে প্রতি লাখে গড়ে মৃত্যু হয়েছে ২০২ জন করে মানুষের। সে তুলনায় স্প্যানিশ ফ্লুর সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় একই অঞ্চলে ১৯১৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে গড়ে মৃত্যু হয় ২৮৭ জন করে আক্রান্তের।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমান অনেক উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একই সময়ে নিউ ইয়র্কে ফ্লুতে প্রতি লাখে মৃত্যু ছিল ৫০ জন। অথচ কোভিডে সেটা বেড়ে চার গুণ (২০০) হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, কোভিড-১৯ মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে বেশি মারাত্মক হবে। মৌসুমি ফ্লু নিয়ন্ত্রণের জন্য জন্য টিকা আছে। কিন্তু কোভিডের কোনো টিকা এখনো সফলভাবে প্রয়োগ করা যায়নি।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০ আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডে আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩.১ শতাংশ। দেশটিতে প্রায় দশমিক ০৫ শতাংশ মৃত্যু হার ছিল বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ। সে সময় মৃত্যুর হারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে ছিল শুধু পেরু, স্পেন, চিলি ও ব্রাজিল।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিডিসি জানিয়েছে, মৌসুমি ফ্লুতে বার্ষিক মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ বা ১২ হাজার থেকে ৬১ হাজার। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে সার্বিক মৃত্যু হার শূন্য দশমিক ০০৬৫ শতাংশ। এ শতাংশ নিরূপণ করা হয় আক্রান্ত সব ব্যক্তির বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে।
গ্লোবাল চেইঞ্জ ডাটা ল্যাবের মতে, লক্ষণ নেই এমন মাধ্যম থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০ আগস্ট পর্যন্ত কোভিডে বিশ্বে নিশ্চিত আক্রান্তের বিপরীতে নিশ্চিত মৃত্যুর হার ৩.৫ শতাংশ।
সিডিসির নথি অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে বিশ্বজুড়ে মৃত্যু হয় এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ জন থেকে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৪০০ জনের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিল ১২ হাজার ৪৬৯। অন্যদিকে করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০ আগস্ট পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এ ভাইরাসে মৃত্যু হয় এক লাখ ৭৪ হাজারের বেশি মানুষের।
ইউএসএ টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আক্রান্তের প্রায় পাঁচ মাস পর সোয়াইন ফ্লুর ভ্যাকসিন আসে। অথচ দেশটিতে প্রথম আক্রান্তের অষ্টম মাসেও কোভিডের কোনো টিকার সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়নি।
গ্লোবাল চেইঞ্জ ডাটা ল্যাবের ভাষ্য, কোভিডে মৃত্যুর সঠিক বিশ্লেষণের জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর সম্ভাবনা বা সংক্রমণে মৃত্যুর হারকে বিবেচনায় নেয়া উচিত। সঠিকভাবে হিসাব করতে হলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মোট সংখ্যা জানতে হবে। রোগের গতি-প্রকৃতি বোঝাসহ বেশ কিছু বিষয় মোট আক্রান্তের সংখ্যা নিরূপণে গবেষকদের ঝামেলায় ফেলেছে।
ইউএসএ টুডের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ফেসবুকে পোস্ট করা মিমে শুধু সংখ্যা দিয়ে স্প্যানিশ ফ্লু ও মৌসুমি ফ্লুর মৃত্যুর সঙ্গে কোভিডে মৃত্যুর তুলনা করা হয়েছে। এ তুলনা যথার্থ নয়। মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে বেশি দ্রুত হারে ছড়ায় করোনাভাইরাস। এটি মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে বেশি সংক্রামক।
মিমের দাবি ও ইউএসএ টুডের মূল্যায়ন
ইউএসএ টুডের গবেষণা অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা মিমে স্প্যানিশ ফ্লুতে মৃত্যুর হার বেশি ছিল বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা আংশিক মিথ্যা। ১৯১৮ সালের ফ্লু ও মৌসুমি ফ্লুর মৃত্যুর হার নিয়ে যেসব পরিসংখ্যান শুরুতে দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগ ছিল সত্য। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য ও গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ উল্লিখিত দুটি রোগের চেয়ে বেশি প্রাণঘাতী।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমটির গবেষণা মতে, বিশ্বে জনসংখ্যার বিপরীতে কোভিডে মৃত্যুর হার কোনো এক সময়ের জন্য সঠিক হলেও এ সংখ্যাটা ভাইরাসে মৃত্যুর হারের প্রতিফলন নয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ। সর্বশেষ ডাটা অনুযায়ী, মৃত্যুর এ সংখ্যাটা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং মৌসুমি ফ্লুতে বার্ষিক মৃত্যুর হারের চেয়েও বেশি।