মহান মুক্তিযুদ্ধে সুরে ও কথায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা। বিজয়ের দিনে তাদের কণ্ঠেই বেজে উঠেছিল গোটা জাতীর বিজয় উল্লাস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল পুরো জাতির বিজয়ের উন্মাদনা। সেই গান তৈরির গল্প নিউজবাংলাকে শুনিয়েছেন শব্দসৈনিক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ ও তিমির নন্দী।
বুলবুল মহলানবীশ
‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমাদের রিপোর্টিং টাইম ছিল সকাল ১০টা। আমরা প্রতিদিন এই সময়ই যেতাম। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সকাল ১০টা ছিল অন্যরকম। সেদিন বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে দেখি মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। আমরা তো হকচকিয়ে গেলাম। পরে মিষ্টি বিতরণের কারণ জানলাম।
আমাদেরকে বলা হলো, তোমরা তাড়াতাড়ি রিহার্সেল রুমে চলে যাও। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিচের তলায় একটা হলরুম ছিল। সেদিন সেখানেই আমাদের রিহার্সেলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সুজয় দা (সুজেয় শ্যাম) সুর দিচ্ছিলেন আর শহীদুল ইসলাম লিখছিলেন।
গানের স্থায়ীটা লেখা হলো। সুজয় দা হারমোনিয়াম পাচ্ছিলেন না। মুখে মুখেই সুর দিচ্ছিলেন। পরে একসময় হারমোনিয়াম পেলেন কোনোরকমে। স্থায়ীটা সুর করলেন, আমরাও শিখে নিলাম।
খুব ভালো মনে নেই। তবে আমরা ধারণা, আমরা রিহার্সেলে বসেছি ১২টার দিকে। গান লেখা ও সুর করার বিষয়টি সুজেয় শ্যাম ও শহীদুল ইসলাম আরও আগে থেকেই শুরু করেছেন। আমরা বেশ তাড়াতাড়িই স্থায়ীটা তুলে নিতে পেরেছিলাম।
শব্দসৈনিক বুলবুল মহলানবীশ
অন্তরার লাইনগুলো শহীদুল ভাই আমাদের সামনে বসেই লিখছিলেন। আর সুজয় দা সুর করছিলেন। যেহেতু দুটি অন্তরার লাইনগুলোতে একইরকম সুর, তাই আমাদের বেশি সময় লাগলো না। আমরা গানের কথাগুলো শুধু তুলে নিলাম।
এর মধ্যে যেটা হলো- রিহার্সেলরুমে বিশাল বড় একটা জানালা ছিল, সেখান দিয়ে মূল গেটটা দেখা যেত। সেখান দিয়ে আমি দেখলাম আমার স্বামী সাব সেক্টর কমান্ডার এস কে লালা এসেছেন। তাকে দেখে তো আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আর দাঁড়ানোর কারণে অজিৎ দা (অজিত রায়) আমাকে প্রচণ্ড এক ধমক দিলেন। অজিত দা গানটির লিড দিচ্ছিলেন।
আমি তো ধমক খেয়ে হু হু করে কান্না শুরু করে দিলাম। কল্যাণী দি (কল্যাণী ঘোষ) আমার স্বামীকে চিনতেন। তিনি অজিত দা-কে বললেন, যুদ্ধ শেষ করে বুলবুলের স্বামী এসেছে, ওকে আপনি এভাবে ধমক দিলেন? তখন তো অজিত দা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেলেন- ঠিক আছে, তুই তোর স্বামীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আয়। পরে আমি আমার স্বামীর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এলাম।
সাক্ষাৎপর্বের পর ছিল আমাদের দুপুরের খাবার পর্ব। সেগুলো শেষ করে আমি এলাম গান রেকর্ডিং করতে। তখন ২টা বা তার একটু বেশি বাজে। আমাদের গান রেকর্ডিং করতেও সময় খুব কম লাগল। আমার যতোদূর মনে পড়ে, ২টা ৩০ মিনিটের মধ্যে আমাদের গান রেকর্ডিং শেষ।
রেকর্ডিংয়ে রথীন্দ্রনাথ রায়, প্রবাল চৌধুরী, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, মান্না হক, মৃণাল কান্তি দাস, অনুপ ভট্টাচার্য, তপন মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রূপা ফরহাদ, মালা খুররম ছিলেন। আরও আরও ছিলেন; তাদের নাম এখন মনে পড়ছে না।
গানটি রেডিওতে প্রচার হলো ভারতীয় সময় বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে; যখন রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্বসমার্পণ করেছে, তখন আমাদের এই গানটি বাজছে।
এই গানটি আমার কাছে বা আমরা যারা ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, তাদের কাছে শুধু গানের জন্ম নয়, এ এক দেশের জন্ম। এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত।
আমরা চার ভাই-বোন সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান করেছি। জানুয়ারির ২ তারিখে আমরা ঢাকা চলে আসি।
তিমির নন্দী
‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, প্রতিদিনের মতো কিছু গানের রিহার্সেল চলছিল। যতদূর মনে পড়ে ‘জীবন যুদ্ধে আমরা সবাই লড়ছি’, ‘শোনো শোনো বাংলার সংগ্রামী জনতা’ এই গান দুটোর রিহার্সেল চলছিল। হাঠাৎ করেই খবর পেলাম ঢাকা সারেন্ডার করবে।
সব গানের রিহার্সেল বন্ধ করে দিয়ে শহীদুল ভাই (শহীদুল ইসলাম) বললেন- নতুন গান তৈরি করতে হবে। সুজয় দা সুর করতে বসলেন, আর অজিত দা-কে বললেন গানের লিড দিতে।
শব্দসৈনিক তিমির নন্দী
অন্যদিকে আমরা তো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেউ হাসছি, কেউ কাঁদছি। কলকাতার পথেও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আনন্দ মিছিল দেখেছি।
আমাদের গান খুব তাড়াতাড়ি তোলাও হয়ে যায় এবং রেকর্ডও হয়ে যায়। মজার বিষয় হলো, ভারতীয় সময় ৪ টা ৩১ মিনিটে যখন গানটি রেডিওতে বাজছে, তখন কিন্তু রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনি আত্মসমার্পণও করছে।
আমি ১৬ ডিসেম্বরেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চলে আসি।’