প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতোদিন নয় দফা দাবিতে চলে আসা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার তারা সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষণা করলেন।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মহাসমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুতই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম থেকে ছাত্র নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্র সংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা শিগগিরই আপনাদের সামনে তুলে ধরব।’
শনিবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মহাসমাবেশে জমায়েত হওয়া শিক্ষার্থী-জনতা। ছবি: নিউজবাংলা
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা আজকে এক দফার দাবিতে এখানে হাজির হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘একদিকে গ্রেপ্তার-নির্যাতন করা হচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের সংলাপের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। সরকার এখন বলছে, আলোচনার জন্য গণভবনের দরজা খোলা রয়েছে। আমরা মনে করি সরকার প্রধান আগেই বুঝে গেছেন যে গণভবনের দরজা খোলা রাখতেই হবে। আমরা শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি।’
‘শুধু পদত্যাগ করলেই হবে না, দেশে যত খুন-গুম হয়েছে তার দায়ে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। শুধু শেখ হাসিনা নয়, পুরো মন্দ্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হবে’, যোগ করেন নাহিদ।
নাহিদ বলেন, ‘এই ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থাকে বিনাশ করতে হবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চাই যেখানে আর কখনোই কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসবে না। আমাদের এক দফা হলো- শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিদায়।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারের লুটপাট ও গণহত্যাসহ সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সব রাজবন্দির মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রয়োজনে জেল ভেঙে আমাদের ভাইদেরকে মুক্ত করে নিয়ে আসব।
‘আমরা জনগণকে বলতে চাই, স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। আপনারা তার সঙ্গে এসে যোগ দিন। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় সংগঠিত হোন।’
প্রয়োজনে গণভবন ঘেরাও করা হবে জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলবে। আমরা সরকারকে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন করব না। যদি কোনোভাবে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ দেয়া হয় তা আমরা প্রত্যাখ্যান করব।’
তিনি বলেন, ‘সবার প্রতি আহ্বান থাকবে- আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ ও রাজপথের কর্মসূচি পালন করবেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন। নিরাপত্তা বাহিনী, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা সবার প্রতি আহ্বান, জনগণ যদি সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে, সরকার যদি জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় সেই সরকারের হুকুম মানতে আপনারা আর বাধ্য নন।’
আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ বলেন, ‘সরকারকে সমর্থন না দিয়ে আপনারা জনগণের পাশে দাঁড়ান। আপনাদের আমাদের মিছিলে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা হুকুমের আসামির বিচার চাই, আপনাদেরকে খুন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা সব গণহত্যার বিচার করবই।’
নাহিদ বলেন, ‘আমরা এক দফা সরকার ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ ঘোষণা করছি। এজন্য ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থান আহ্বান করছি।’
সমাবেশ থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জরুরি নির্দেশনা দেন আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা দেবেন না। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কল-কারখানা বন্ধ থাকবে।
‘আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না। সব ধরনের সরকারি সভা, সেমিনার, আয়োজন বর্জন করবেন।’
‘বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোন ধরনের পণ্য খালাস করবেন না। দেশের কোনো কল-কারখানা চলবে না, গার্মেন্টসকর্মী ভাইবোনেরা কাজে যাবেন না। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না।’
আসিফ আরও বলেন, ‘জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে। পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোনো ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধু থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে।
‘বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ডিউটি পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক এবং কোস্টাল এলাকায় থাকবে। আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলার কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না।’
তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সব অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে। বিলাসদ্রব্যের দোকান, শো-রুম, বিপণি-বিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে!’
আসিফ বলেন, ‘হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহন সেবা যেমন-ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এই খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সেবা চালু থাকবে।’
এর আগে বিকেল ৩টা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাবিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। সমাবেশের স্থান শহীদ মিনার পেরিয়ে আশপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আগত জনতা। এ সময় পুরো এলাকাজুড়ে ছাত্র-জনতা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সমাবেশে যোগ দিতে অনেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন স্ত্রীকে, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মা আর বাবা। আবার অনেকে পরিবারের সব সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে সমাবেশস্থলে হাজির হয়েছেন।
এদিকে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শহীদ মিনারের এই জমায়েতে যোগ দেন রবীন্দ্রসরোবরে থাকা শিল্পীরাও।
কর্মসূচি ঘোষণা শেষে সন্ধ্যা ৭টায় সমন্বয়কদের আহ্বানে সবাই শহীদ মিনার এলাকা ছাড়তে শুরু করেন।