কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে হত্যা, গুম আর গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ এবং আটককৃতদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ ব্যানারে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে এই দাবি জানানো হয়।
সমাবেশের শুরুতে আন্দোলনে নিহতদের ‘শহীদ’ উল্লেখ করে তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়৷ এছাড়াও সমাবেশ থেকে চলমান আন্দোলন ঘিরে প্রাণহানির ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ নামে অভিহিত করার আহ্বান জানানো হয়।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘আমার ছাত্রছাত্রীদের ওপর যে লাঞ্ছনা হয়েছে এটির বিচার আমরা কারও কাছে চাই না। তার বিচার বিধাতা করবেন। কিন্তু আপনারা আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন না।
‘আমরা জন্মেছি একবার, মরবোও একবার। সুতরাং আমাদের ভয় দেখাবেন না। ছাত্রছাত্রীদের ওপর জুলুম বন্ধ না করলে পরিণতি যে কারও জন্য ভালো হয় না সেটা ইতিহাস বলে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্রছাত্রীদের গায়ে গুলি কেন? আমি শিক্ষক হিসেবে জানি, আমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, এজন্যই এখানে দাঁড়ানো। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না এটা ভেবে যে, আমাদের সন্তানদেরকে এভাবে মারা হচ্ছে। আমাদের ক্ষোভ প্রকাশের আসলে ভাষা নেই।’
আবেগতাড়িত কণ্ঠে এই শিক্ষক বলেন, ‘অনুভূতির জায়গা থেকে যদি চোখের পানি পড়ে, অনুরোধ করছি সেটাকে আমার দুর্বলতা ভাববেন না। সেটা আমার ক্ষোভ আর ঘৃণার প্রকাশ।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘১৯৬৯ সালে অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। আমরা এখানে যারা জমায়েত হয়েছি, আমরা শহীদ শামসুজ্জোহার উত্তরসূরী। আর যে সন্তানেরা বৈষম্যহীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি। এই লড়াইয়ের ফলাফল কী হবে সেটা ইতিহাসই আমাদের নির্দেশ করছে। আর আমাদের করণীয় কী সেটা ইতিহাস আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আমরা সেই দায়িত্ব নিশ্চয় পালন করব।’
সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদ ফেরদৌস বলেন, “এই দেশে কোনো আইন নেই, বিচার নেই, গণতন্ত্র নেই। একটি রাষ্ট্র কতটা দেউলিয়া হলে গোয়েন্দা এজেন্সিকে মানুষ ‘ভাতের হোটেল’ নামে ডাকতে পারে। সেখানে রাতের অন্ধকারে মানুষজনকে তুলে নেয়া হয়। তাদের খোঁজ করতে যখন পরিবার-পরিজনরা যায়, তখন তাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, কোনো খবর জানানো হয় না, পথ আটকে রাখা হয়।”
তিনি বলেন, ‘সরকার দেখাতে চেয়েছে ভাতের হোটেলের ছবি। কিন্তু আমরা দেখেছি নাহিদের হাতে-পায়ে আঘাতের জখম। সরকার ভুল ও মিথ্যাচারের পথে হাঁটছে।
‘শিক্ষার্থীদের আপনারা প্রতিপক্ষ ভাবছেন। সেই শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের খোল-নলচে পাল্টে দিতে এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রে যে লাগাতার নৈরাজ্য চলেছে, হলগুলোতে যে সুপরিকল্পিত নিপীড়ন চলেছে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সেসব কিছুকে পাল্টে নতুন ইতিহাস লিখবার পথ তৈরি করেছে এই শিক্ষার্থীরা।’
অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস আরও বলেন, ‘ছাত্রদের মৃত্যুতে যাদের সংশ্লিষ্টতা আর দায় আছে তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হোক। আমরা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার দাবিকে সমর্থন করি। কিন্তু সবার আগে হত্যা বন্ধ হোক। সবার আগে গুম, অপহরণ বন্ধ হোক।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরিদী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সায়মন রেজা, ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন প্রমুখ।
সমাবেশ শেষে শিক্ষকরা নিহতদের স্মরণে গান গেয়ে গেয়ে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনাকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আসেন। পরে তারা আবার অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ফিরে তাদের কর্মসূচি শেষ করেন।