শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যতটুকু ক্যাপাসিটি ছিল সেই ক্যাপাসিটি থেকেই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিনশ’ কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে জানিয়ে উপাচার্য বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে হলগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছ থেকে আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্নের মাধ্যমে হলগুলো সংস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
শুক্রবার সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত রোকেয়া হল এবং স্যার এ এফ রহমান হল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন উপাচার্য।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়া, সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান এবং সংশ্লিষ্ট হলের প্রাধ্যক্ষদ্বয় উপস্থিত ছিলেন।
ঢাবি উপাচার্য শুক্রবার সকালে রোকেয়া হল ও স্যার এ এফ রহমান হল পরিদর্শন করেন। ছবি: নিউজবাংলা
উপাচার্য মাকসুদ কামাল বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত রুমগুলোর অ্যাসেসমেন্ট করেছি। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা মঞ্জুরি কমিশন থেকে আর্থিক বরাদ্দ চাইব। সেই বরাদ্দ দিয়ে আমরা ভাঙচুর করা ৩০০ টি রুম সংস্কার করব। আরও বহু স্থাপনায় আঘাত করা হয়েছে। সেগুলোও রিপেয়ার করার পরিকল্পনা আছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন আমরা রুমগুলোর সংস্কার করে শেষ করব, দেশব্যাপী যখন একটা স্থিতিশীলতা আসবে, শিক্ষার্থীদের যখন আমরা আশ্বস্ত করতে পারব, পাশাপাশি হলগুলো যখন প্রস্তুত হবে তখন আমরা খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
কতদিনের মধ্যে খোলা হবে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘মঞ্জুরি কমিশন থেকে আমাদের অর্থপ্রাপ্তির বিষয় রয়েছে। তাদের আবার মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। অর্থ পেলে সেটি আবার টেন্ডার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। টেন্ডার প্রাপ্তির পর সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব হবে যে কবে নাগাদ আমাদের এই কাজ শেষ হবে এবং কবে নাগাদ হলগুলো খোলা হবে।
‘যতটুকু করণীয়, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সেদিনের ভূমিকা আর প্রস্তুতি নিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘রাজু ভাস্কর্যে সেদিন সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রাম ছিল দুপুর ১২টায় আর ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম ছিল ৩টার সময়। আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিল।
‘৩টার কাছাকাছি সময়ে সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যখন হল পাড়ার দিকে আসে সেই দুপুরের সময় আমাদের প্রভোস্টরা হলে ছিলেন না। প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদেরও বিষয়টি জানা ছিল না।
‘আমি খবর পাওয়ার পর প্রক্টরিয়াল টিম ও প্রভোস্ট মহোদয়দের বিষয়টি অবহিত করি। ততক্ষণে মারামারি শুরু হয়ে যায়। তখন দেখি দুপক্ষের হাতেই লাঠি। এই সময় প্রক্টরিয়াল টিমও সেখানে পৌঁছতে পারেনি। আর প্রভোস্টরাও আটকা পড়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। তার ওপর শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই অপরিচিত, তাদের অনেকেই প্রক্টরিয়াল টিমকে চেনে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি ছিল না। সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রাম শেষে অন্যরা তাদের প্রোগ্রাম করবে- সেজন্য আমাদের প্রক্টরিয়াল টিম প্রস্তুত ছিল। আমাদের যদি জানা থাকত যে সেখানকার একটি মিছিল এদিকে আসবে তখন আমাদের সেই প্রস্তুতিটাও থাকত। আকস্মিকভাবে এটি ঘটেছে।
‘এ ধরনের মবকে কন্ট্রোল করা, যখন সবার হাতে লাঠি তখন আমাদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই মবটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আমাদের যতটুকু করণীয় ছিল আমরা আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করেছি।’
উপাচার্য বলেন, ১৫ তারিখ যে সংঘর্ষটি হয়েছে সেটি আগে থেকে আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের জানা ছিল না। প্রক্টরিয়াল টিমকে অবহিত করা হয়নি। দুপুরবেলা আমাদের প্রভোস্টরা যখন খেতে গিয়েছেন সেই সময় এই ঘটনা ঘটে যায়।’
‘ছয় ঘণ্টা অবস্থানের পরও পুলিশকে হলে প্রবেশের অনুমতি দেইনি’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘১৫ জুলাই বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শহীদুল্লাহ হলের সামনে যে ঘটনা ঘটেছে সে সময়ও আমরা পুলিশকে শহীদুল্লাহ হলে প্রবেশ করতে বারণ করেছি। এই হলের সামনে পুলিশ ৬ ঘণ্টা অবস্থান করেছে। তারপরও কিন্তু আমরা তাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেইনি।
‘পরদিন আমরা যখন হলগুলো বন্ধ করে দিয়েছি, সেদিনও পুলিশ হলগুলোতে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। আমরা তাদের সেই অনুমতিও দেইনি। পুলিশ তাদের নিজস্ব কোর্স অফ অ্যাকশন হিসেবে যা করেছে তা তারা নিজেরাই করেছে।’
‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্যই ক্যাম্পাসে পুলিশ’
উপাচার্য বলেন, ‘পুলিশ যে ক্যাম্পাসে এসেছে সেটি আমাদের সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাদের আসতে হয়েছে। কখনও কখনও এটি তারাও চেয়েছে।
‘১৬ তারিখ সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রাম ছিল শহীদ মিনারে আর ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম ছিল রাজু ভাস্কর্যে। দু’পক্ষই সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্যই শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনে আমরা পুলিশকে অবস্থান নিতে বলেছি। তাদেরকে এ-ও বলেছি- তারা যেন কোনো টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ না করে।’
মাকসুদ কামাল বলেন, ‘ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ ক্যাম্পাসে অবস্থা নিয়েছে। কখনও কখনও আমরা শুনেছি যে বাইরে থেকে হলগুলোতে আক্রমণ করা হবে। কখনও শুনেছি বহিরাগতরা আক্রমণ করবে আবার কখনও শুনেছি প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা আক্রমণ করবে। সেই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ছিলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়েই আমরা পদক্ষেপগুলো নিয়েছি।’
সংঘর্ষ শুরুর দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পরদিন পর্যন্ত প্রক্টরিয়াল টিম এবং হলগুলোর প্রাধ্যক্ষ ও হাউজ টিউটরবৃন্দ সারারাত জাগ্রত ছিলেন বলে দাবি করেন উপাচার্য।
তিনি বলেন, ‘১৫ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা সারারাত জাগ্রত ছিলেন আর দিনভর কাজ করেছেন। হলগুলোর প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররাও সারারাত জাগ্রত ছিলেন। কখনও কখনও আমরা রাতের বেলা জুমে মিটিং করে প্রভোস্টদের ইনস্ট্রাকশন দিয়েছি। আমাদের যতটুকু ক্যাপাসিটি ছিল সেই ক্যাপাসিটি থেকেই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করেছে। আর সেই আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছি আমরা। আমার পাশের রুমেই প্রায় ছয়/সাত দিন অর্থাৎ ৮ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত তারা সেই আলোচনাটি করেছে। আমরাও চেয়েছি এই বিষয়টির যেন দ্রুতগতিতে সমাধান হয়।’
‘ছাত্ররাজনীতি চলেবে- এমন কথা বলিনি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন অর্থাৎ ১৬ জুলাই রাত থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বের করে দিয়ে হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হবে মর্মে একাধিক বিজ্ঞপ্তিতে হল প্রাধ্যক্ষের স্বাক্ষর নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে আজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চলবে’ মর্মে উপাচার্য বক্তব্য দিয়েছেন দাবি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেল।
তবে এই ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, ‘চ্যানেলটির সেই প্রতিবেদক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই তথ্য ছড়িয়েছে।’
উপাচার্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য আমি দেইনি। কোনো সাংবাদিক আমাকে এটি নিয়ে কোনো প্রশ্নও করেননি। আমার সম্পূর্ণ ভিডিও ইউটিউবে আছে। যমুনা টিভির সাংবাদিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই তথ্য ছড়িয়েছেন। এখন সেটি তাদের ফেসবুক এবং ইউটিউব থেকে সরিয়ে দেবে বলেছে।