‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সোমবার।
বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি পালন উপলক্ষে নানামুখী কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
পূর্ববাংলার মুসলমানদের মাঝে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯২১ সালে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়।
ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নির্মাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সাংবাদিক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদও তার বইয়ে লিখেছেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ঐতিহাসিক।
১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তানিরা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রধান ভূমিকায় ছিলেন।
এ জন্যই হয়তো বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়; একটি জনপদের মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন ও উত্থানের ৫০ বছরের ইতিহাস।
স্বাধীনতার পর প্রতিটি গণতান্ত্রিক, মৌলবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সর্বদা ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বিভিন্ন সময়ে নিজ দায়িত্ব হিসেবে কাঁধে তুলে নেয়। যেকোনো সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে দেশ ও জাতি এমন প্রত্যাশা করে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে কার্যক্রম বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়ালেও বিগত কয়েক দশক ধরে শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট, গেস্টরুম সংস্কৃতি, গবেষণার অপ্রতুলতা এবং সেকেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সেবার কারণে সমালোচনায় জর্জরিত হচ্ছে।
গত বছর অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল উপাচার্যের দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এর ফলে আশার আলো দেখছেন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন নির্ধারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে উপাচার্য এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে নিজের পরিকল্পনা জানান।
তিনি বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন নির্ধারণ করেছি: ‘Create a world-class educational ecosystem that enables individuals to act as dynamic human capital and ethical leaders for a sustainable future.’”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন এবং এ সম্পর্কিত মিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অ্যাকাডেমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান এবং ফিজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
উপাচার্য জানান, অ্যাকাডেমিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই বিদ্যাপীঠ উচ্চতর গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে, যা কার্নেগির শ্রেণিবিভাজন অনুযায়ী R2 বিশ্ববিদ্যালয়। এই ধারাবাহিকতায় ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি রূপান্তরিত হবে গবেষণা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা কার্নেগির বিভাজনে R1 বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান R3 বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য, অর্থাৎ গবেষণা থেকেও পাঠদানকে এখানে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত অ্যাকাডেমিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে অনেক বিভাগের শিক্ষার্থী-সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হবে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কিছু নতুন বিভাগও খোলা হবে।
শুভেচ্ছা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল। পাশাপাশি অভিনন্দন জানিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে।
বর্ণাঢ্য কর্মসূচি
বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মাধ্যমে সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন শুরু হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’।
এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে পায়রা চত্বরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও হোস্টেল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী শোভাযাত্রা সহকারে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সমবেত হন।
স্মৃতি চিরন্তন চত্বর থেকে সকাল পৌনে ১০টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে পায়রা চত্বরে গমন করেন।
সকাল ১০টায় পায়রা চত্বরে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন হয়।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর সকাল সাড়ে ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আলোচনা সভায় অংশ নেন।
আলোচনা সভার শুরুতে দিবসটি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘স্মরণিকা’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নীলক্ষেত ও ফুলার রোড সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। এ সময়কালে বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়।
দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলা ভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশপথে তোরণ নির্মাণ এবং রোড ডিভাইডার ও আইল্যান্ডসমূহে সাজসজ্জা করা হয়।