ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) পায়রা চত্বরে বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিন বসিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের খেলা দেখাচ্ছে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ। আর সেই ডিজিটাল স্ক্রিনের জন্য বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হয়েছে টিএসসি থেকে।
খেলা দেখানোর এই দেড় মাসব্যাপী আয়োজন ঘিরে ক্যাম্পাস জুড়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা, ব্র্যান্ডিং। অথচ এসব কিছুই করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো অনুমতি না নিয়ে।
ক্যাম্পাস জুড়ে চলছে নগদের ব্র্যান্ডিং। ছবি: নিউজবাংলা
সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং এর চারপাশের এলাকায় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদের ব্যানার, ফেস্টুন আর প্লাকার্ডের ছড়াছড়ি। টিএসসির প্রবেশ পথে নগদের ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়েছে গেট। আর পায়রা চত্বরে বসানো হয়েছে বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিন।
এছাড়া ডাস চত্বর, রোকেয়া হল এবং আধুনিক ভাষা ইনিস্টিউট হয়ে টিএসসি যাওয়ার পথে দুই পাশের রাস্তায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে হয়ে টিএসসি এবং শেখ রাসেল টাওয়ার হয়ে টিএসসি যাওয়ার রাস্তায় বসানো হয়েছে নগদের ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন।
পায়রা চত্বরে বসানো ডিজিটাল স্ক্রিনের জন্য বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হয়েছে টিএসসির ভেতর থেকে। আর রাস্তার ধারে টাঙানো ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ডের জন্য বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বৈদ্যুতিক তার থেকে।
ডিজিটাল স্ক্রিন বসানো, ব্যানার, ফেস্টুন আর প্লাকার্ড টাঙানোর কাজটি নগদ দিয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ইএফএ-কে। আর এই প্রতিষ্ঠানের একজন জানান, আগামী ৪৫ দিনে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত গড়ে পাঁচ ঘণ্টা খেলা দেখাতে জায়ান্ট স্ক্রিন চালু থাকবে।
দেখা যায়, প্রতিদিন খেলা শুরু হওয়ার ত্রিশ মিনিট আগে থেকে এই ডিজিটাল স্ক্রিন সচল হয়। আর তাতে বিরতিহীন চলতে থাকে নগদের প্রচারণা। আর খেলায় প্রতি ওভার শেষে যে বিরতি থাকে সে সময়ও চলে নগদের প্রচার।
যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
দেড় মাসব্যাপী এমন আয়োজনের জন্য নগদ কোনো অনুমতি নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তারা উপাচার্য স্যারের কাছে অনুমতি চেয়েছে। ফাইনালি তারা (নগদ) অনুমতি পেয়েছে কিনা সেটি নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়নি।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আমার কাছে তারা কোনো আবেদন করেনি বা আমি কোনো অনুমতি দেইনি।
‘নগদ আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে আর খেলা দেখাচ্ছে; অথচ আমাদের থেকে তারা অনুমতি নেয়নি। অনুমতি দিলে তো বিশ্ববিদ্যালয় দেবে। অনুমতি না নিয়ে তারা এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান করতে পারে না।’
যা বলছে নগদ
নগদের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার (২ জুন) নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের আয়োজনে আমরা ভালোভাবে সংযুক্ত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটা ভালো সখ্য হয়েছে। এরপর থেকে কোনো খেলা হলেই আমরা আপনাদের খেলা দেখাই। সবশেষ গত বিশ্বকাপ ফুটবলও আমরা দেখিয়েছি। বলা যায় এটা একটা রিচ্যুয়ালের মতো হয়ে গেছে।
‘এই আয়োজনের বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলেই আমরা এটি করেছি। কারও মাধ্যমে আমরা যাইনি বা কথা বলিনি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো থার্ড পার্টি তো আমাদের পারমিশন দিতে পারবে না।’
তাহলে আপনাদের ব্যানার-পোস্টারে ‘সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ’ লেখা কেন- এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটার উত্তর আমি দিতে পারব না। এ ব্যাপারে আমার সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে।’
নগদের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এরকম কর্মকাণ্ডের আগে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ ছাড়া অনুমোদিত এলাকার বাইরে ব্র্যান্ডিং বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম আমরা করছি না।’
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
খেলা দেখানো আর ব্র্যান্ডিংয়ে নগদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে এটা জানেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সোমবার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘নগদ জায়ান্ট স্ক্রিনের জন্য বিদ্যুৎ কোত্থেকে নিচ্ছে সেটা তো দূরে থাক তারা যে খেলা দেখাচ্ছে সেটিই আমি জানি না। কেউ না জানালে আমি জানব কীভাবে?’
টিএসসি থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখি।’
খোঁজ নিয়ে কী দেখেছেন জানতে পরদিন মঙ্গলবার দেখা করলে আহসান হাবিব বলেন, ‘এটি আমার এরিয়ার মধ্যে পড়ে না। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রই এটি দেখভাল করবে। বিদ্যুতের ব্যাপারে তারা আমাদের কিছু জানালে তখনই আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই।’
জানা যায়, সোমবার রাতেই টিএসসি থেকে নেয়া বিদ্যুৎ সংযোগ কাটতে প্রকৌশল দপ্তরের কয়েকজন সেখানে গেলে তাদের বাধা দিয়ে এই সংযোগ কাটতে দেয়া হয়নি।
অনুমতির বিষয়ে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) উপ-পরিচালক ফারজানা বাসার বলেন, ‘নগদের সঙ্গে আমাদের কারও কথা হয়নি। তাদের থেকে আমরা কোনো ফি-ও নেইনি। আমি জানি ছাত্রলীগের আয়োজনে এটা হচ্ছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই আমাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। তখন আমি তাদের করতে বলেছি। আর বলেছি, ব্যানার এমনভাবে লাগাবে যেন আমাদের কোনো স্থাপনা ঢেকে না যায়।’
টিএসসির আরেকজন উপ-পরিচালক নজির আহমেদ সিমাব বলেন, ‘এটার জন্য তারা আমাদের কাছ থেকে প্রোপারলি অনুমতি নেয়নি। নগদের সঙ্গে তো আমাদের কথাই হয়নি। শুধু এতোটুকু জানি, ছাত্রলীগের ছেলেরা এটার আয়োজন করছে। কারা করছে সেটাও জানি না। আপনি ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললে বেটার হয়।
‘আমরাও চাই না কোনো কোম্পানি ক্যাম্পাসের ভেতরে এভাবে বাজেভাবে ব্র্যান্ডিং করুক। তারা রাস্তাসহ মোটামুটি আশপাশের সব জায়গায় ব্র্যান্ডিং করছে। এটা নিয়ে গতবারও ঝামেলা হয়েছে।’
ছাত্রলীগ সহযোগিতায় নাকি মূল আয়োজনে?
এদিকে টিএসসি ও আশপাশের এলাকাজুড়ে বসানো নগদের প্লাকার্ড ও ব্যানারে লেখা রয়েছে যে তাদের এই আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
নগদের একজন কর্মকর্তাও জানান, তারাই এই আয়োজন করেছেন। আর ছাত্রলীগ সহযোগিতা করছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বলছে, তারাই এই আয়োজন করেছে; আর সেটিতে স্পন্সর করে সহযোগিতা করেছে নগদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়েছি। এরপর আমাদের আয়োজনে নগদ স্পন্সর করে সহযোগিতা করেছে।’
নগদের বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের খেলা দেখাবে আর বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে না এটা কেমন কথা?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি জানে না জানালে সৈকত বলেন, ‘তাহলে এটি আমি বলতে পারব না কেন ওনারা এরকম কথা বলেছেন। তবে উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি ছিলাম না। আমার সভাপতি (মাজহারুল কবির শয়ন) ছিল। আমি ছিলাম প্রক্টর স্যারের সঙ্গে কথা বলার সময়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘আমরা এটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। এখন কেন তারা অস্বীকার করছেন সেটা আমি জানি না। আর নগদ শিক্ষার্থীদের খেলা দেখাবে, আর তার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কি তারা বাইরে থেকে এনে ব্যবহার করবে?’
শয়ন বলেন, ‘তবে আমরা তাদের (নগদ) বলেছি, তাদের ব্র্যান্ডিং বা প্রচারণা যেন শুধু টিএসসির ভেতরের এরিয়াতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। টিএসসির বাইরে তারা ব্র্যান্ডিং করলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইল টিম ব্যবস্থা নেবে।’
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বড় একটি এলাকা বাণিজ্যিকভাবে প্রচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নগদকে সুযোগ করে দিয়ে ভালো অ্যামাউন্টের টাকা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
এই অভিযোগ ঢাবি ছাত্রলীগের এই দুই শীর্ষ নেতা অস্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, ‘তাদের থেকে টাকা নেব কেন? তারা আমাদের খেলা দেখানোর জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে তো। টাকা নেয়ার কোন বিষয় নেই।’