ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় প্রশাসন ইনিস্টিটিউটে (আইবিএ) প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন নিজ ক্যাম্পাসের ছাত্রীকে যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজু সাহা।
জাবির সাবেক এক ছাত্রী গত ২৩ মার্চ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাজু সাহার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন। তার অভিযোগের ব্যাপারে সব প্রমাণ নিয়ে ঈদের পর লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি নিয়োগ বোর্ডে যখন সাজু সাহাকে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়, তখনও ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগ আসেনি বলে জানিয়েছেন বোর্ডের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার। তিনি বলেন, ‘এখন যদি কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে বিষয়টি আমলে নেয়া হবে।’
সাবেক ছাত্রীর কী অভিযোগ
অধ্যাপক সাজু সাহা কাউন্সেলিং করানোর নামে তাকে নিপীড়ন করেছেন উল্লেখ করে সাবেক ওই ছাত্রী বলেন, ‘তিনি আমার গায়ে হাত দিয়েছেন। আমাকে তার সঙ্গে হুক-আপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। উনার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য রেস্টুরেন্টে আমার পা পর্যন্ত ধরতে চেয়েছেন। এ সবের ট্রমায় আমি এক সেমিস্টার ক্লাসেও নিয়মিত হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘এসব আমি এতোদিন উপস্থাপন করার সাহস পাইনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইরুজ অবন্তিকার ঘটনার পর আমি এগুলো সামনে আনার সাহস পাই।’
সাবেক ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘সাজু সাহা ভয়ে আছেন; আমার অভিযোগের ব্যাপারে। কারণ, তিনি তো জানেন, তিনি আমার সাথে এসব করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও উনি নিশ্চিত একই কাজ করবেন নারী শিক্ষার্থীর সাথে। উনার বিচার নিশ্চিত করেই ছাড়বো আমি, শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
যা বললেন জাবির মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আরিফুল হক বলেন, ‘বিষয়টা আমরা জেনেছি। এটা নিয়ে আমরা সভাও করেছি। সেই শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা হবে। আমরা তার পরিবারের সাথেও কথা বলেছি। তাদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।’
ছাত্রীর বক্তব্য
লিখিত অভিযোগ দেয়ার বিষয় ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি গিয়েছিলাম। যেহেতু লিখিত অভিযোগ দিতে হবে, আর এর সাথে অভিযোগের স্বপক্ষে সব প্রমাণ সংযুক্ত করতে হবে, এসব প্রমাণ সংযুক্ত করা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই– স্যারের কাছ থেকে একটু সময় নিয়েছি। আমি ঈদের পর এসেই অভিযোগ দেব।’
যা জানা গেল শিক্ষক সাজু সম্পর্কে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সহকারী অধ্যাপক সাজু সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিবিএতে তার রেজাল্ট ছিল পঞ্চম, আর এমবিএতে তিনি যৌথভাবে প্রথম। অর্থাৎ আরও তিন শিক্ষার্থীর সমান নম্বর তিনি পেয়েছিলেন। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে তার ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট নামের একটি কোর্সে ইমপ্রুভমেন্ট আছে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন সাজু সাহা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হন সহকারী অধ্যাপক। প্রভাষক থাকা অবস্থায় একবার (২০১৯) আর সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পর আরও দুইবার (২০২১ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২২ সালের জুলাই) তিনি ঢাকা মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক পদে আবেদন করেছিলেন। প্রতিবারই তিনি তার রেজাল্টের কারণে বাদ পড়েছেন। আর এবার তিনি এই রেজাল্ট দিয়েই নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন আইবিএতে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আপনি যার কথা বলছেন তিনি (সাজু সাহা) আমার ছাত্র। আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় দুইবার তার আবেদন জমা পড়েছিল। তার রেজাল্টের কারণে সর্বসম্মতিক্রমে দুইবারই তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। শুনেছি, এরপর আরও একবার তিনি আবেদন করেন। সেবারও তিনি বাদ পড়েন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক অধ্যাপক বলেন, ‘আইবিএতে সাধারণত এই ইনস্টিটিউটের ডিগ্রি ছাড়া কাউকে নিয়োগ করা হয় না। তবে কারও যদি বিদেশি কোনো উচ্চতর ডিগ্রি থাকে সেক্ষেত্রে তারাও সুযোগ পায়। আইবিএর কোন ডিগ্রি বা বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকার পরও সাজু সাহা একটি রাজনৈতিক দলের পদধারী হওয়ায় সিলেক্ট হয়েছেন।’
যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে এই শিক্ষক বলেন, ‘আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে সবাই নির্দোষ। তবে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় এই ধরনের কোনো অভিযোগই অনেক গুরুতর। তাই আমার মত হলো, যে অভিযোগ উঠেছে সেটি তদন্ত করে দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। এমনও হতে পারে তিনি দোষী না। আবার যদি তিনি সত্যি সত্যিই দোষী হয়ে থাকেন তাহলে কিন্তু এই কালিমা আমার প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়েই লাগবে।’
নিয়োগ প্রক্রিয়া
সোমবার বিকেল তিনটায় আইবিএর সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম বোর্ড অফগভরন্যান্সের সভায় এই নিয়োগ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এই বিষয়ে বোর্ড অফ গভরন্যান্সের সদস্য অধ্যাপক ড. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আইবিএর ডিগ্রি থাকার যে প্রথার কথা বলা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। এমনকি বর্তমান আইবিএর পরিচালকেরই কোনো আইবিএ ডিগ্রি নেই। আর সাজু সাহার বিরুদ্ধে যেই অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে সেটি আমি শুনিনি। এখন যেহেতু এসেছে বোর্ড অফ গভরন্যান্সে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে বোর্ড অফ গভরন্যান্সের সদস্য সচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. মোমেনকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি। তার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া না দেয়ায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
অভিযুক্ত যা বলছেন
অভিযোগের বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক সাজু সাহাকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে সামনাসামনি বসে কথা বললে আমার তথ্য উপাত্ত দিতে সহজ হবে, আর আপনার নিউজটাও সমৃদ্ধ হবে। আমি এখনই আপনার ক্যাম্পাসে এসে কথা বলছি।’
এর কয়েকঘণ্টা পরও অধ্যাপক সাজু সাহা না আসায় ফের তাকে কয়েকবার ফোন দেয়া হয়, কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্যও জানা যায়নি
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য যা বললেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘সেই নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগের যেসব তথ্য তোমার কাছে আছে সব ডকুমেন্টস তুমি নিয়োগ বোর্ডের প্রধান প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছারকে দিয়ে দাও। উনি সোমবার সভায় সেগুলো উত্থাপন করবেন। আর আমিও জেনে রাখলাম।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘যেহেতু যৌন হয়রানির মতো একটা অভিযোগ উঠেছে উনার বিরুদ্ধে সেহেতু উচিত হচ্ছে বিজি (বোর্ড অব গভর্ন্যান্স) বোর্ডে এই নিয়োগ পাস না করা। এটিকে আপাতত স্থগিত রেখে যাচাই-বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে।’
ফেসবুকে কী অভিযোগ তুলেছেন সেই ছাত্রী
অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে গত ২৩ মার্চ ফেসবুক পোস্টে এই শিক্ষার্থী লেখেন, অনেকদিন চুপচাপ বসে ছিলাম। যে মানুষের ডিপার্টমেন্টে ক্লাসমেটদের সাথে এতো সমস্যা থাকার পরেও কখনো অ্যাটেন্ডেন্সে ৯ এর নিচে আসেনি, তার শেষের দিকে কেন অ্যাটেন্ডেন্সে ০ আসলো এটা কেউ প্রশ্ন করেনি। আমি চাই, আমার সাথে যে অন্যায়টা হয়েছে এটা আর কারো সাথে না হোক।
পোস্টে এই শিক্ষার্থী আরও লেখেন, উনি আমাকে ডিরেক্টলি বলেছেন, আমি ওনার সাথে হুক-আপ করলে উনি আমাকে ক্যারিয়ার, ডিপার্টমেন্ট, বাইরে যাওয়া নিয়ে হেল্প করবেন। আগেও বলেছিলেন এক সাথে পড়াশোনা করে বাইরে যাবেন। আমাকে বলছিলেন, ‘তোমার বিএফ রাগ করবে না?’ আমার বুঝতে বুঝতে একটু দেরিই হয়ে গেছে।
তার ভাষায়–‘এই লোক আমাকে ডিরেক্টলি বলছেন, ‘আমি ভুল মানুষকে চুজ করেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি লিবারাল। তুমি হুক-আপ কালচারে বিশ্বাস করো। কিন্তু তুমি দেখি কনজারভেটিভ।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, আমার বিচার লাগবে না। আমি অ্যাশিওরেন্স চাই উনি যে উনি যেন এমনটা আর কারো সাথে করার সাহস না পান।
পোস্টে এই শিক্ষার্থী লেখেন, ওনার এত কনফিডেন্স যে আমি কিছু প্রমাণ করতে পারব না। কারণ উনি প্রমাণ রাখার মত কিছু রাখেন নাই। তবে যা আছে, তা ওনার দোষ প্রমাণ করতে যথেষ্ট। আমি বুঝতে এত দেরি করে ফেলেছি যে উনি আসলেই মুখোশধারী। উনি ছাড়াও আমার আরও দুইজন শিক্ষিকা আমার মানসিক সমস্যায় সাহায্য করেছেন অনেক আন্তরিকভাবে। তার মানে কি এই মানুষগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার অর্থ আমার তাদেরকে সুযোগ দেয়া!!
তিনি লেখেন, উনি যে রেস্টুরেন্টে বসে তার অন্যায় প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য আমার পা পর্যন্ত ধরতে চেয়েছেন, এর কি প্রমাণ আমি দেব?? উনি যে রিকশায় আমার গায়ে জোর করে হাত দিয়েছেন, তার কি প্রমাণ আমি দেব? রিকশাওয়ালাকে খুঁজে নিয়ে আসব? এটা কি আদৌ সম্ভব!শেষ পর্যন্ত উনি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস তুমি কাউকে কিছু বলবা না।’
পোস্টে ভুক্তভোগী আরও লেখেন, আমার সাথে এই ঘটনার পর উনি (সাজু সাহা) অনেকদিন আমাকে বলেছেন ডিপার্টমেন্ট থেকে রিজাইন দিয়ে দেবেন। এই ক্যাম্পাসে থাকবেন না। ওনার নাকি আমাকে ফেইস করার মুখ নেই। অথচ উনি ঠিকই শিক্ষকতা করছেন। ..আমি যদি আগে একটুও বুঝতাম, আমি চেষ্টা করতাম ওনার কৃতকর্মের প্রমাণ রাখার। তবে যা আছে তা আমি রেখে দিচ্ছি। কেউ আমাকে অ্যাকিউজ করার আগে আমার কাছে সেগুলো চেয়ে নেবেন।