বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) মধ্যরাতে বহিরাগত নিয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের প্রবেশের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন সেটি একটি অন্ধকার গোষ্ঠীর ইন্ধনে পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বুয়েটের পাঁচ শিক্ষার্থী।
তারা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে এই অন্ধকার গোষ্ঠী। না হলে রাজনীতিমুক্ত একটি সুন্দর ক্যাম্পাসে, যেখানে কিছুই হয়নি, সেখানে আন্দোলন করে কেন টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে?
শনিবার বিকেলে বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা বলেন তারা। এই পাঁচ শিক্ষার্থী নিজেদের নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন বুয়েট ক্যাম্পাসে সামাজিক এবং অ্যাকাডেমিকভাবে ভোগন্তির শিকার হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে। তাদের পাশাপাশি আরেকটি অংশও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পাসে।
পাঁচ শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের এই প্রোগ্রামে আরও অনেকের আসার কথা ছিল। তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে; আমাদের প্রোগ্রামে কেউ আসলে তাদের পেটানো হবে।
এই শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা এই প্রোগ্রাম করছি ভয়হীন হয়ে। আপনারা মিডিয়াকর্মীরা যদি না থাকতেন তাহলে এই প্রোগ্রাম করে আমরা জীবন নিয়ে হল পর্যন্ত যেতে পারতাম না। সেই পরিস্থিতি এখন এই বুয়েটে তৈরি হয়েছে। আপনারা চলে যাওয়ার পর আমাদের ওপর আক্রমণও হতে পারে। আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই।
পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে দুই শিক্ষার্থী নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন, কেমিক্যাল ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশিকুল আলম আরেকজন সিভিল ২০ ব্যাচের তানভীর মাহমুদ স্বপ্নীল।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের দাবি আমরা ক্যাম্পাসে সুষ্ঠুভাবে পড়াশুনা করতে চাই এবং পরীক্ষা দিতে চাই। যে যে মতাদর্শে বিশ্বাস করে করুক, তবে স্বাধীনতা বিরোধী কোনো চেতনাকে আমরা লাই দেব না। ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আবরার ফাহাদ ভাইয়ের আবেগকে ব্যবহার করে একটি অন্ধকার সংগঠনের ইন্ধনে চলমানটি আন্দোলনটি পরিচালিত হচ্ছে।
‘বুয়েটে বিরাজনীতির নামে প্রগতিশীল রাজনীতিকে দমিয়ে হিজবুত তাহরীসহ অন্ধকার রাজনীতি মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা কখনোই বলিনি আমরা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চাচ্ছি কিংবা আমরা ছাত্ররাজনীতি করছি। বুয়েটের নিয়মের প্রতি আমাদের সম্মান আছে’ যোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে তানভীর স্বপ্নীল বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগে বুয়েটের সাবেক এবং বর্তমান ৩৪জন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। যাদের নামে এখনো কোর্টে মামলা চলমান এবং সকলে জামিনরত অবস্থায় আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মৌলবাদের বিরুদ্ধে ‘Rise above Fundamentalism’ ব্যানারে মানববন্ধন করি। এই মানববন্ধন করার দরুণ আমাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং জবাবদিহিতা চাওয়া হয়। বিভিন্ন হলের রুমে রুমে রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ডেকে জবাবদিহিতা চায় এবং প্রায় ৭০-৮০জন মিলে দুইজনকে মাঝে ডেকে একটি কালচারাল র্যাগিং করা হয়।
তিনি বলেন, একটি গোষ্ঠীর ইন্ধনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের নিয়ে মিথ্যাচার কর হয়। এমনকি মানববন্ধনকে একটি অপরাধের সাথে তুলনা করে আমাদের হল থেকে বের করে দেয়ারও হুমকি দেয়া হয়।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠভাবে পালনের উদ্দেশে অনলাইন/আইটি রিলেটেড কাজে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে দক্ষ শক্তি তৈরির প্রতিজ্ঞায় রোড টু স্মার্ট বাংলাদেশ নামক অনুষ্ঠানে আমাদের কয়েকজন উপস্থিত হয়, যেটি আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সংগঠিত হয়। এটাকেও ইস্যু করে সেই প্রোগ্রামের নিউজ কাটিং থেকে আমাদের ছবি বের করে, আমাদের চিহ্নিত করে আবারও একটি গোষ্ঠীর দ্বারা সংগঠিত কথিত বিচারকার্যের নাম করে বিভিন্ন রকমের জবাবদিহিতা চাওয়া হয়। এরপর আমাদেরকে বিভিন্নভাবে ফলো করা হয় সব জায়গায় অর্থাৎ আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিই তৈরি হয়ে আছে যে আমরা যারা ভুক্তভোগী তারা যা কিছুই করতে যাই একটা গোষ্ঠীর কাছে সেই জবাবদিহিতা করা লাগছে।
এতে বলা হয়, একদিন সাপ্তাহিক ছুটিতে আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও বড়ভাই-ছোটোভাই মিলে ক্যাফেটেরিয়াতে কাচ্চি রান্না করে খাই। এটাকেও মিথ্যাচার করে রাজনৈতিক তকমা লাগানো হয় এবং বলা হয় গোপনে সেখানে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক উপস্থিত ছিলো। যেটি পুরোপুরি বানোয়াট এবং মিথ্যা।
তারা বলেন, ‘এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দোষী সাব্বস্ত করে সব রকমের গ্রুপ ও ক্লাব থেকে শিক্ষকদের কোনোরূপ অনুমতি না নিয়ে বের করে দেয়া হয়। সকল ধরণের স্টাডি ম্যাটারিয়েলস দেয়া বন্ধ করা হয়, আমাদেরকে ডিপার্টমেন্ট, হল, ক্লাবের প্রোগ্রাম থেকে বাদ দেয়া। ভালো খেলা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় বা ডিপার্টমেন্ট এ খেলতে বাধা দেয়া হয়। ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ হওয়াসহ সকল ধরনের জায়গাতে যেতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করিনি এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত নই তবে আদর্শের দিক থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসী এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সাথে আছি। আমাদেরকে র্যাগার, খুনী, মাদকাসক্তসহ আরো অনেক ন্যাক্কারজনক অপবাদ দেয়া হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন হলে ইফতার বিতরণ করি যেটাতেও একই ধরণের অপবাদ আমাদের উপর দেয়া হয়। আমাদের এই গুটিকয়েক চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছেলেদের বিরুদ্ধে কারা এবং কাদের ইন্ধনে এসব করা হচ্ছে তা একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে। মিথ্যাচার করে আমাদের দোষী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা চেষ্টা করছে একটা মৌলবাদী গোষ্ঠী।
এই পাঁচ শিক্ষার্থী বলেন, যাদের পরিবার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, তাদেরকে ধরে ধরে নিয়মিত র্যাগিং, বুলিং, হুমকি ও ভয় ভীতির মধ্যে জীবন কাটাতে হচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য স্যারকে জানিয়েছি। বুয়েটের বাইরে এমনকি এলাকার কোন প্রোগ্রামে গেলেও আমাদের জবাবদিহি করতে হয়।
‘এসব কিছু এটাই প্রমাণ করে দেয় ছাত্ররাজনীতিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসে এখন প্রায় প্রকাশ্যেই হিজবুত তাহরির তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এবং সেই নিষিদ্ধ সংগঠনের মানুষ তাদের স্বার্থ হাসিল করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ ব্যবহার করে’ যোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
২০১৯ সালে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও গত বুধবার মধ্যরাতের পর বহিরাগত কিছু নেতা-কর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান। পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম ছাত্রলীগ নেতাদের সমাগম ঘটান বলে অভিযোগ।
এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ শেষ করার আগে শিক্ষার্থীরা রোববারও টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করার ঘোষণা দেন।
বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে আমরাও সহমত। কিন্তু এগুলো পূরণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য সময় প্রয়োজন।’