কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বাধার প্রেক্ষিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সমিতির নেতারা। এক পর্যায়ে উপাচার্যকে ‘ডাস্টবিন’ সম্বোধন করে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান।
বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচ তলায় এ ঘটনা ঘটে।
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার পর প্রথমে শিক্ষক সমিতির নেতারা উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তর্ক করতে থাকেন। এসময় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনকে উদ্দেশ্য করে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘আপনি পদত্যাগ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন।’
এই কথার জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘আপনার কথায় পদত্যাগ! হু আর ইউ টু আস্ক মি টু রিজাইন?’
বাগবিতণ্ডা চলাকালে উপাচার্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। তার নামে প্রকাশিত আর্টিকেল তিনি টাকা দিয়ে করেছেন বলে দাবি করেন অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন।
তার দাবি, উপাচার্যের নিজের কোনো ভালো মানের আর্টিকেল নেই, অথচ শিক্ষকদের ওপর ভালো আর্টিকেলের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘আমার ৩৯টি আর্টিকেল রয়েছে। আর যে সময় আমি আর্টিকেল প্রকাশ করেছি, সেসময় বিদেশি জার্নালে বাংলাদেশি কারও আর্টিকেল গ্রহণ করত না।’
তিনি বলেন, ‘যারা অযোগ্য, তারা প্রমোশন পাবে না। ভালো জার্নালে একটি আর্টিকেল লেখার যোগ্যতা যাদের নেই, তারা কীভাবে প্রমোশন পাবে?
‘কোনো অযোগ্য শিক্ষককে আমি নিয়োগ দেই না, প্রমোশনও দেই না। পত্রপত্রিকায় অযোগ্য শিক্ষকদের লিস্ট দিলে দেখতে পাবেন কারা অযোগ্য। আমি তাদের প্রমোশন দেই না।’
এক পর্যায়ে শিক্ষক সমিতির নেতারা প্রশ্ন তোলেন, ‘কোনো ভালো জার্নালে আপনার একটি ভালো মানের প্রকাশনা নেই। তাহলে আপনি কীভাবে অধ্যাপক হলেন?’
জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘আমি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশন পেয়েছি। আমাকে যিনি নিয়োগ দিয়েছেন উনি আমার বিষয়টি অ্যাসেস (যাচাই) করেই দিয়েছেন। আমিও যাকে দেব তারটাও অ্যাসেস করেই দেব।’
বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী রানাকে জিগ্যেস করেন, ‘উনি টিচারদের অপমান করে কেন? স্টপ হিম। স্টপ দিস ডাস্টবিন। দিস ডাস্টবিন, জাস্ট স্টপ হিম। দিস ইজ কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি।’
তখন উপাচার্য অধ্যাপক মঈন জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কি বললেন? আই উইল টেক ইউ ইন দ্য রাইট প্লেস।’
প্রত্যুত্তরে মেহেদী হাসান বলেন, ‘আই এম নট টকিং টু ইউ। আই এম টকিং টু হিম (প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী)।’
এ সময় উপাচার্য শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ক্লাস না নেয়ার অভিযোগ তুললে শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেন, ‘আপনি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এভাবে মিথ্যাচার করতে পারেন না। আমরা ক্লাস না নিলে ক্লাস কে নেয়? আপনি তো ক্লাস নেন না।
‘আমরা যদি ক্লাস না নেই, তাহলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট কমিয়ে এত এগিয়ে যাচ্ছে কীভাবে? র্যাংকিংয়ে উন্নয়ন হচ্ছে কীভাবে?’
নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত
এর আগে, সকাল ১০টার দিকে শিক্ষক সমিতির নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, সিলগালাহীন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতি, কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে আনয়ন, ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের অনুপস্থিতি ইত্যাদি অনিয়মের অভিযোগ তুলে পরীক্ষায় বাধা দেন। পরে পরীক্ষা পিছিয়ে দেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল দশটায় শুরু হবার কথা থাকলেও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয় সাড়ে দশটায়। তার আগে (সকাল দশটার দিকে) শিক্ষক সমিতির সদস্যরা উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করে এই পরীক্ষা বন্ধ করতে বলেন।
এরপর সাড়ে দশটায় উপাচার্য প্রশাসনিক ভবনের ৪১১ নম্বর কক্ষে চলা পরীক্ষার হলে গেলে সেখানে শিক্ষক সমিতির সদস্যরাও প্রবেশ করেন। এ সময় তারা নিয়োগ পরীক্ষা ‘অবৈধ’ ও ‘প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে’ অভিযোগ তোলেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুষদের ডিন ও বিভাগটির বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে এই পরীক্ষা কোনোভাবে বৈধ নয় বলেও অভিযোগ করেন।
পরীক্ষা বোর্ড কমিটির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান। তারা ছাড়াও দুজন বহিরাগত পরীক্ষকের (এক্সটারনাল) মধ্যে একজন উপস্থিত ছিলেন। কমিটির দুই সদস্য, ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শেখ মকছেদুর রহমান এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকারও অনুপস্থিত ছিলেন।
নিয়োগ পরীক্ষায় বাধা দেয়ার বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক মেহেদী হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে বাধা নয়, আমরা অবৈধ এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে চেয়েছি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও নীতিমালাবিরোধী। আজকের এই পরীক্ষার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ৷
‘কোনো প্রকার খাম ছাড়াই খোলা প্রশ্ন একজন কমিটির বাইরের লোককে দিয়ে পরীক্ষার হলে নিয়ে আনা হয়েছে।’
নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত না থাকা প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শেখ মকছেদুর রহমান বলেন, ‘প্রশাসনের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে সাধারণ শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ। যেহেতু শিক্ষক সমিতি সাধারণ শিক্ষকদেরই প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন, তাই শিক্ষক সমিতির যে সেন্টিমেন্ট, তার সঙ্গে অন্যান্য সকল সাধারণ শিক্ষকের মতো আমিও একমত। সেজন্য বোর্ডে যাইনি।’
তিনি বলেন, ‘যদি বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধান করা হয়, তবেই আমি বোর্ডে যাব। আর যতদিন এইসব সমস্যার সমাধান না হবে, আমি বোর্ডে যাব না।’
এই বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনকে ফোন করলে তিনি তার অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলেন। পরে অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন সাংবাদিকদের জানান, ‘শিক্ষক সমিতি প্রশ্নফাঁসের যে অভিযোগ এনেছে, তা পুরোপুরি মিথ্যে ও বানোয়াট।’