ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ২৮৬টি কলেজের ৭৫ হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। পাসের হার ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশের অভিযোগ, শিক্ষাবোর্ডের প্রযুক্তিগত ত্রুটি বলি হয়েছেন তারা। ফল প্রকাশের আগ মুহূর্তে নতুন করে রোল নম্বর নির্ধারণ করায় তাদের ফল পাল্টে গেছে।
ফেল করা শিক্ষার্থীদের অনেকের দাবি, প্রবেশপত্রে থাকা রোল নম্বরই তারা পরীক্ষার খাতায় লিখেছিলেন। অথচ ফল প্রকাশের তারা জানতে পারেন যে প্রবেশপত্র ও রোল নম্বর বদলে গেছে। নতুন প্রবেশপত্র অনুযায়ী তাদেরকে ফল নিতে হয়েছে। আর রোল নম্বর পাল্টে যাওয়ায় তাদেরকে অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ভালুকা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন ৫৬ পরীক্ষার্থী। পাস করেন মাত্র ১৬ জন। তাদের একজন কাকন আক্তার তার নতুন রোল নম্বরে অনলাইনে অনুসন্ধান করে দেখেন, নিজের নামের পরিবর্তে সুসং দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের মাজহারুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীর নাম আসে।
একই ঘটনা ঘটেছে ওই কলেজের ইসরাত জাহান জেরিনসহ নতুন রোল পাওয়া ৫১ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে। ভালুকার মর্নিং সান স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও বাটাজোর সোনার বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গফরগাঁও উপজেলার হুরমত উল্লাহ কলেজসহ আরও কয়েকটি কলেজের পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
পরীক্ষায় প্রবেশপত্রের রোল নম্বর জটিলতার বিষয়টি নিয়ে পরদিন সোমবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালামের কাছে যান কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সেখানে তারা দাবি করেন, কলেজগুলো কারসাজি করে এমনটি করেছে। শতভাগ পাস করানোর জন্য কিছু শিক্ষার্থীকে গ্যারান্টি দিয়ে এনে ভর্তি করে তাদের শুধু পাস করানো হয়েছে। বাকিদের ফেল করানো হয়ে থাকতে পারে।
এ সময় শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন ভালুকা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর শিক্ষা বোর্ডের সামনে মানববন্ধন করেন অকৃতকার্য এসব শিক্ষার্থী।
বাস্তবেই এ বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষার ফল পরিবর্তন হয়েছে নাকি বিষয়টি অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের বোঝার ভুল- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে নিউজবাংলা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের নিজস্ব জনবল সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় এই বোর্ডের কাজটি করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর শিক্ষা বোর্ড। প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ফল প্রকাশের আগমুহূর্তে ধরা পড়ে জটিলতা। পরীক্ষার খাতায় লেখা বিভিন্ন শিক্ষার্থীর রোল নম্বরে অন্য শিক্ষার্থীর ফল আসতে থাকে। এমন অবস্থায় বিষয়টি সমাধানে কাজ করে শিক্ষা বোর্ড। পরে রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও খাতার সঙ্গে মিল করে ফল তৈরি করা হয়।
তবে এমনটা মানতে নারাজ ফেল করা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা মনে করেন, খাতায় লেখা রোল নম্বর এবং পরে ফলাফলের জন্য দেয়া অন্য রোল নম্বরের জন্যই ভুল ফল এসেছে। তাই আবারও খাতা দেখে সুষ্ঠুভাবে ফল তৈরি করে তা প্রকাশ করতে হবে। নয়ত অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে বোর্ডের সামনে লাগাতার মানববন্ধন করা হবে।
এদিকে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, একটি মহল অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা জানি যে কোন রাজনৈতিক নেতা এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীকে নিয়ে রাজনীতি করছে। এক রাজনৈতিক নেতা বোর্ডে একটি কাজে সুপারিশ করেছিলেন। সেটি না মানায় ফেল করা শিক্ষার্থীদের উস্কে দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয় ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাকেও জানানো হয়েছে।’
তবে শিক্ষার্থীরা বাইরের কারও ইন্ধনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভালুকা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী কাকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খাতায় লেখা রোল নম্বরে ফল প্রকাশ না করে নতুন রোল নম্বরে প্রকাশ করার কারণেই ফেল করেছি। আমার আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে পাস করব। কারও ইশারায় আমরা ক্ষুব্ধ হয়ে মানববন্ধন করিনি। আমাদের খাতাগুলো নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে আবারও দেখে ফল প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।’
একই কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাফিজ উদ্দিন সুমন বলেন, ‘এমন ফলাফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আমাদের দায়ী করেছেন। অথচ এসব বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। ফেল করা শিক্ষার্থীরা আসলেই ফেল করেছে কিনা, তা বোর্ডই ভালো বলতে পারবে।’
একই বক্তব্য দিয়েছেন মর্নিং সান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আতাউর রহমান জুয়েল।
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. সামছুল ইসলাম বলেন, ‘৮ হাজারের মতো শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ডুপ্লিকেশন হয় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে। পরে সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি তদারকি করে ফল প্রকাশের এক মাস আগে নতুন প্রবেশপত্র পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রোল নম্বর পরিবর্তনের সঙ্গে ফলের কোনো সম্পর্ক নেই।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. গাজী হাসান কামালের সঙ্গে কথা বলে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে। ফল প্রস্তুত করা হয় রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে। এ জন্য রোল নম্বর প্রয়োজন নেই। যেগুলোতে সমস্যা হয়েছে, সেগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছে। ফল সঠিক রয়েছে। তারপরও লিখিতভাবে আবেদন করলে পুনরায় খাতা দেখে সমাধান করা হবে।’