‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’- বহুল প্রচলিত এ বাংলা প্রবাদটি মেয়েদের একসঙ্গে অনেক কাজ দক্ষভাবে করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আর একেই যেন আবারও বাস্তবে প্রমান করলেন ফরিদপুরের এইচএসসি পরীক্ষার্থী স্মৃতি আক্তার।
পরিবারের অভাব স্মৃতির পড়াশোনা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু চায়ের দোকান চালিয়ে অভাবকেই হারিয়ে দিয়েছেন স্মৃতি। পাশাপাশি নিজের পড়ালেখা চালু রেখে এবারের এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
অভাবের সঙ্গে লড়াই ও চায়ের দোকান চালিয়েও বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের ময়না গ্রামের স্মৃতির এ সাফল্য মুগ্ধ করেছে সবাইকে। তার এ সাফল্যে অনেকেই তার বাড়িতে যেয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
স্মৃতি আক্তার জানান, এসএসসিতে তেমন একটা ভালো ফলাফল করতে না পারায় এবার সে কঠিন সংকল্প করেই পরিশ্রমের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত এ সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বোয়ালমারীর কাজী সিরাজুল ইসলাম মহিলা কলেজের ছাত্রী হিসেবে পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে এ ফলাফল অর্জন করে সে।
সে আরও জানায়, তাদের পিতা মো. হারুন শেখ পেশায় একজন তাল গাছের ব্যবসায়ী। তারা দুই বোন ও এক ভাই। বড় বোন মনিকা আক্তারও অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করেই ফরিদপুরের সারদা সুন্দরী কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
ময়না বাজারের পাশেই তাদের বাড়ি। আর বাড়ির পাশেই ছোট একটি মুদি দোকানের সঙ্গে আয় বাড়ানোর উপায় হিসেবে চা বিক্রির একটা দোকান করেন তারা। স্মৃতি আর তার বোন মনিকা দুজনে পালাক্রমে নিজেরাই এ দোকান চালান।
স্মৃতির মা আসমা আক্তার জানান, তার শ্বশুর প্রায় ৩০ বছর আগে বাড়ির পাশে মুদি দোকান করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে তার স্বামী হারুন শেখ দোকান শুরু করেন। ছোটবেলা থেকে তাকে সহায়তা করতো মেয়েরা। তবে আয় উপার্জন তেমন একটা না হওয়ায় এ দোকান ছেড়ে তিনি তাল গাছ বেচাকেনার ব্যবসা শুরু করেন। এরপর পরিবারের অভাব ঘুচাতে পিতার বদলে দুই মেয়ে দোকানের ভার গ্রহণ করেন। আস্তে আস্তে দোকানের একপাশে গড়ে তুলেন ছোট একটি চায়ের স্টল।
স্মৃতি আক্তার বলেন, ‘পরিবারের আয় ও পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্য দুই বোন বাড়ির পাশে মুদি দোকানে চা বিক্রি শুরু করি। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সারাদিনে চা বিক্রির পাশাপাশি সময় পেলেই পড়াশোনা করি। পাশাপাশি রাতে যেটুকু সময় পাই কাজে লাগাই।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে স্মৃতি বলেন, ইচ্ছে ছিলো চিকিৎসক হবে। তবে অর্থের অভাবে ইচ্ছে থাকলেও মানবিক বিভাগে পড়তে হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারিনি। তাই উচ্চ শিক্ষা লাভ করে এমন একটি পেশায় নিবেদিত হতে চাই যেখান থেকে মানুষের সেবা করতে পারবে।’
স্মৃতির পিতা হারুন শেখ বলেন, ‘মেয়েদের এ সাফল্যে আমরা খুবই আনন্দিত। এর আগে আমার আরেক মেয়ে অনার্স পাশ করায় ইউএনও ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন। এ টাকাও বড় কাজে লেগেছে তাদের পড়াশোনার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভে বড় বাধা আর্থিক সংকট। এ বাঁধা না থাকলে তারা আরও ভালো ফলাফল করতে পারতো।’
স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. বাচ্চু শেখ বলেন, ‘মনিকা ও স্মৃতির এ সাফল্যের খবর জেনে আমি তাদের বাড়িতে যেয়ে অভিনন্দন জানাই। সারা গ্রামের মানুষ এ খবরে আনন্দিত। তারা ভবিষ্যতে পড়াশোনা করে আরও বড় হোক এ কামনাই পুরো গ্রামবাসীর।’
আর্থিক অভাবের বিরুদ্ধে স্বপ্ন দেখার সংগ্রামে স্মৃতির এ সাফল্য সবাইকে প্রেরণা জোগাবে এ বিশ্বাস স্থানীয় গ্রামবাসীর।