সিলেট নগরের ২৫ নং ওয়ার্ডের কদমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বছর কয়েক আগেও এই বিদ্যালয়ের সামনে বিস্তৃর্ণ উঠান ছিলো। এই উঠানকেই খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতো শিক্ষার্থীরা। এখন এই উঠানের বহুলাংশজুড়ে উঠেছে একাডেমিক ভবন। ফলে হারিয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জায়গা।
বিদ্যালয়টির বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন টিফিন পিরিয়ডেও তাদের স্কালের মধ্যে বসে থাকতে হয়। বড়জোর যাওয়া যায় বারান্দায়। বাসায় গেলেও খেলার কোনো জায়গা নেই। স্কুলেও নেই। আর হাঁটাচলারই জায়গা নেই যেখানে, সেখানে খেলাখুলা কোথায় করবে তারা?
এমন আক্ষেপ শুধু এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের না, বরং সিলেটের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর এই অভিযোগ। কারণ এই বিভাগের দেড় সহসাধিক বিদ্যালয়ে নেই কোনো খেলার মাঠ। বিশেষত নগর এলাকার বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের বাইরে ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। মাঠ-সংকটে অনেকটা বন্দি হয়েই ক্লাসরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয় শিশুদের। মাঠের অভাবে অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করাও সম্ভব হয় না। এতে শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগের মোট ৫ হাজার ৫৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ আছে ৩ হাজার ২০৩টি বিদ্যালয়ে। বাকী ১ হাজার ৮৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো মাঠ নেই। এর মধ্যে সিলেট জেলার ১ হাজার ৪৭৭ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫৬টির মাঠ নেই। সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৪৬৭ বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ নেই ৬৮৬টির। মৌলভীবাজারে ১ হাজার ৪৮ বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩২০টির মাঠ নেই। হবিগঞ্জের ১ হাজার ৬৬ বিদ্যালয়ের মধ্যে মাঠ নেই ৩৯৩টির।
নগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিস্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই আগে খেলার মাঠ ছিলো। অন্তত মাঠ না থাকলেও বিদ্যালয় ভবনের সামনে প্রশস্ত খোলা জায়গা ছিলো। তবে শিক্ষার্থী বাড়ায় ও পুরনো ভবন জরাজীর্ন হয়ে পড়ায় এসব ফাঁকা জায়গায় নতুন একাডেমিক ভবন তৈরি করা হয়েছে। এতে হারিয়ে গেছে খেলার মাঠ।
নগরের ৪০ নং ওয়ার্ডের জান আলী শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার দেব বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের সামনে আগে ফাঁকা জায়গা ছিলো। এখন নতুন ভবন হওয়ায় আর ফাঁকা জায়গা নেই। পাশের জমিতে ধান কাটা শেষ হলে বছরের কিছুটা সময় শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারে।’
নগরের রায়নগর সোনারপাড়া এলাকার বখতিয়ার বিবি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি ও লাফালাফি করছে। মিরাবাজার এলাকায় কিশোরীমোহন বালক প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ে। এখানে ক্লাসরুম আর বারন্দা ছাড়া ফাঁকা কোনো জায়গা নেই। বিদ্যালয় ভবনটি একেবারে সড়ক লাগোয়া হওয়ায় দুর্ঘটনার ভয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হতেই দেন না শিক্ষকরা। ফলে বিদ্যালয়েও অনেকটা বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে শিশুদের।
বখতিয়ার বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন শ্রেণিকক্ষের চাইতে মাঠেই বেশি সময় কাটাতাম। স্কুলের পাশে বিশাল মাঠ ছিলো, পুকুর ছিলো। স্কুল শেষে সাঁতার কাটতাম পাশের পুকুরে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই মন চাইত না। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। কারণ স্কুলে মাঠ তো দূরে থাক চারদেয়ালের বাইরে একটু ফাঁকা জায়গা নেই তাদের। ফলে, শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও শরীরচর্চা ছাড়াই বেড়ে উঠছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।’
খেলার মাঠ না থাকায় শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে জানিয়ে সিলেট মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, ‘খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তো পড়ালেখার চাইতে শিশুরাই খেলাধুলাই বেশি করবে। প্রাথমিকে শ্রেণীকক্ষের থেকে খেলার মাঠ কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের পাঠদান প্রক্রিয়াকে আনন্দময় করে হবে। যাতে তারা শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহী হয়। এ কারণেও বিদ্যালয়গুলোতে প্রচুর খেলাধুলার সুযোগ থাকা দরকার। না হলে তারা বিদ্যালয়বিমুখ হয়ে পড়বে। এর প্রভাব তাদের পরবর্তী শিক্ষাজীবনেও পড়বে।’
খেলার মাঠ না থাকায় সমস্যার কথা উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট জেলার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদন থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে শিশু-কিশোররা ঘরে বসে যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে। তারা স্কুল থেকে ফিরেই টিভিতে কার্টুন দেখা, তা না হলে কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে গেমস খেলা শুরু করে। সামাজিকতা থেকেও তারা দূরে সরে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে বিদ্যালয় তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক জালাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘এখন নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাঠের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সরকারও এ ব্যাপারে আন্তরিক।’
শিশু কিশোরদের খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে নগরে আরও ৪টি খেলার মাঠ করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান। এ ব্যাপারে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনও আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান তিনি।