১৯৮৯ সালে স্থাপিত কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত মালতীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে এক শিক্ষক দিয়েই চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষককে একাই করতে হয় স্কুলের পরিস্কার-পরিছন্নতা, পতাকা উত্তোলনসহ সকল দাপ্তরিক কাজ।
শিশু শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ৬টি ক্লাসের ১০৪ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে ওই শিক্ষককে। এক ক্লাসে গেলে অন্য ক্লাস থেকে যায় ফাঁকা। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা কাঙ্খিত পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন অভিভাবকগণও।
রোববার দুপুরে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক মাত্র ৪জন। এর মধ্যে সহকারি শিক্ষক জান্নাতুল আল ফেরদৌস মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। আর বাকি তিনজন শিক্ষকের মধ্যে দুজন ডিপুটেশনে অন্যত্র গেছেন। এর মধ্যে শিক্ষিকা শ্রীমতি মালা রানী গোড়াই পাচঁপীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং বিলকিছ জাহানকে আনন্দ বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্তি করা হয়েছে। ফলে সিদ্ধান্ত মালতীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা তামান্না ফেরদৌসী একাই সামলাচ্ছেন শতাধিক শিক্ষার্থীকে। শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে গিয়ে অলস সময় কাটিয়ে ফিরতে হচ্ছে ঘরে। এতে বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে উদ্বিগ্নতার মধ্যে আছেন অভিভাবকরা।
৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী হরিপ্রিয়া সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশু শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণির ৬টি ক্লাস একজন শিক্ষকই নেন।
হরিপ্রিয়া বলে, ‘অনেক সময় স্যার আমাদের পড়া দিয়ে আবার অন্য ক্লাসে চলে যান সেই ক্লাসের পড়া দেখাতে। এ জন্য স্যার আমাদের ক্লাসের পড়া ভালোভাবে আদায় করার আগেই ক্লাসের সময় চলে যায়। সামনে আমাদের পরীক্ষা, প্রস্তুতিও নেই তেমনটা। শিক্ষক কম থাকায় অনেকেই বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষক না থাকায় আমাদের পড়ালেখার খুব ক্ষতি হচ্ছে।’
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শ্যামল চন্দ্র বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট থাকলেও শিক্ষা অফিস কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শিক্ষক সংকটের কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের প্রাইভেট মাস্টার দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছে। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আমিনুর রহমান বলেন, ‘সরকার কোটি টাকা খরচ করে সুন্দর একটি ভবন দিয়েছে পড়াশোনা শেখার জন্য। কিন্তু শিক্ষা অফিসারদের অনিয়ম আর গাফলতির কারণে আমাদের সন্তানরা তাদের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
বিদ্যালয়ের একমাত্র সহকারি শিক্ষক তামান্না ফেরদৌসী বলেন, ‘একাই শিশু থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসগুলো নিতে হচ্ছে। শিক্ষক সঙ্কটে বিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। কেননা দ্বিতীয় তলায় ক্লাস নিতে গেলে নিচতলায় শিক্ষার্থীরা বিশৃঙ্খলা করে। বিদ্যালয়ে আমাকে গেট খোলা, পতাকা উত্তোলন, পাঠদানসহ সব কাজ একাই সামলাতে হচ্ছে। এতে করে আমার একার পক্ষে বিদ্যালয় সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
তিনি শিক্ষা অফিসে দ্রুত শিক্ষক দেয়ার অনুরোধ করছেন বলেও জানান নিউজবাংলাকে।
বিদ্যালয়ের জমিদাতা ও সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষক দুজনে স্কুল উন্নয়নের স্লিপের টাকা আত্মসাৎ ও নানান অনিয়ম করায় স্কুল কমিটির সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব হয়। এছাড়া সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করে তারা ডিপুটেশনের নামে নিজের পছন্দসই স্কুলে বদলীও হয়েছেন। শিক্ষা অফিস তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ওই শিক্ষকদের পুরস্কৃত করেছে। ফলে একজন মাত্র শিক্ষক দিয়ে চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান।’
পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনা ব্যহত হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে বলে জানান তিনি।
উলিপুর উপজেলায় শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর সহকারি শিক্ষক শ্রীমতি মালা রানীকে গোড়াই পাচঁপীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বিলকিছ জাহানকে আনন্দ বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে সংযুক্তি করা হয়। তাদেরকে ৩১ অক্টোবর নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। এই ডেপুটেশন আগামী বছরের ৩১ অক্টোবর ডেপুটেশনের মেয়াদ শেষ হবে বলেও অফিস আদেশে বলা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক দিয়ে পাঠদানের কথাটি স্বীকার করে বলেন, ‘ডেপুটেশনে বদলী হওয়া ওই শিক্ষকদের স্থানে অন্য একজনকে দেয়া হয়েছে। আরেকজন শিক্ষকের সুপারিশ দিলেই পদায়ন করা হবে। তবে উলিপুর শিক্ষা অফিস থেকে স্লিপের টাকা আত্মসাৎ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার কোনো অভিযোগ আমাকে দেয়া হয়নি।’