আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এগুলো কোনো নদীতীরের পন্টুন বা লঞ্চ ঘাট। আর সেখানে থাকে নৌপথের যাত্রীদের আনাগোনা, হাঁকডাক। তবে বাস্তবতা তা নয়। এগুলো বিদ্যালয় ভবন। যাত্রী নয়, এই ভবন ও সংশ্লিষ্ট মাঠ জুড়ে দিনভর থাকে শিশু-কিশোরদের কোলাহল।
বাস্তবতা হলো, শিক্ষাবর্ষের ছয় মাসই বিদ্যালয়গুলোতে সেই চিত্র নজরে পড়ে না। কারণ বছরের অর্ধেকটা সময় জুড়ে জলাবদ্ধতায় স্কুল ভবনে যাতায়াত করাটা হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য। থাকে জীবনহানির ঝুঁকিও। শিক্ষা কার্যক্রমও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
পাবনার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল এলাকায় বিদ্যালয় তিনটির অবস্থান। এগুলো হলো- বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শারীর ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বলতে গেলে বিলের মাঝখানেই এসব বিদ্যালয়ের অবস্থান। বর্ষার শুরু থেকে প্রায় ছয় মাস এই তিনটি স্কুল ভবন থাকে জলমগ্ন। বিদ্যালয়ে যেতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় নৌকা। অনেক অভিভাবকই তখন সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সাহস পান না। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি নেমে এসেছে অর্ধেকে।
স্কুল ভবন ঘিরে জলাবদ্ধতার এই সমস্যা বরাবরের। এ অবস্থায় সময়মতো বিদ্যালয়ে পৌঁছানো ও নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে স্থায়ী নৌকা সুবিধার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এই প্রতিবেদক সম্প্রতি নৌকায় চড়েই বিদ্যালয়গুলোর ভবন সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নৌকায় করে বিদ্যালয়ে আসছেন- এমন দৃশ্যও তার নজরে পড়েছে।
উপজেলার বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আরিফা খাতুনকে প্রতিদিন নৌকায় করে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। শিশুটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পরিবার। কারণ আরিফার ৩ বছর বয়সী বোন জামিলা খাতুন গত মাসের প্রথম দিকে নৌকায় চড়তে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়।
আরিফা বলে, ‘আমার বোন ডুবে যাওয়ার পর থেকে বাবা-মা আমাকে নৌকায় করে স্কুলে পাঠানোর জন্য উদ্বিগ্ন থাকেন। কিন্তু আর কোনো উপায় তো নেই। স্কুলে না আসলে আমি অনেক ক্লাস মিস করতাম।’
সুজানগরের গাজনার বিলে বস্তাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাশ জলমগ্ন। মাঝে শ্রেণীকক্ষে চলছে পাঠদান। ছবি: নিউজবাংলা
আসমা খাতুন নামে আরেক শিশু শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলে যেতে ওকে প্রতি মাসে একজন নৌকার মাঝিকে ১৫০ টাকা দিতে হয়। তারপরও বেশিরভাগ দিন তার স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। কারণ নৌকায় করে স্কুলে আসতে অনেক সময় লাগে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মমিন উদ্দিন বলেন, ‘সরকার ২০১৪ সালে এই গ্রামে প্রথম বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। শুরু থেকেই আমরা শিক্ষার্থী পেতে সংগ্রাম করে আসছি। বর্তমানে গাজনার বিল এলাকায় তিনটি বিদ্যালয় রয়েছে। সব বিদ্যালয় ভবনই পানিতে তলিয়ে গেছে।
‘যাতায়াতের সমস্যা থাকায় শিক্ষার্থী পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই স্কুলে ৬৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হতে পারছে।’
পার্শ্ববর্তী শারীর ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে অনেক শিক্ষার্থীকে ভেজা পোশাকেই ক্লাস করতে দেখা গেছে।
বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র রোহিত বলে, ‘আমরা নৌকায় করে স্কুলে যাতায়াত করি। এখন প্রায় প্রতিদিনই সকালে বৃষ্টি হয়। তাই স্কুলে আসার পথে আমরা ভিজে যাই।’
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মাসুরা খাতুন বলে, ‘কখনও কখনও আমরা নৌকা থেকে পড়ে ভিজে যাই। অবশ্য আমরা বেশিরভাগই সাঁতার জানি। কিন্তু তারপরও বাড়ি থেকে সবাই আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে।’
প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলটি জুনের শেষ থেকে জলমগ্ন আছে এবং সম্ভবত নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই জলাবদ্ধ অবস্থা থাকবে।’
২৩৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১২০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থী এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হতে পারে বলে জানান তিনি।
উভয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা সরকারের কাছে স্থায়ী নৌকা সুবিধার দাবি জানিয়েছেন যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সময়মতো বিদ্যালয়ে পৌঁছা এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে।
সুজানগর উপজেলার গাজনার বিলে পাইকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। ছবি: নিউজবাংলা
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এলাকার তিনটি বিদ্যালয়ে প্রায় ৫৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে।
সুজানগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার বলেন, ‘সুজানগর উপজেলার ১৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শারীর ভিটা, বস্তাল ও পাইকপাড়া বিদ্যালয় প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। এর ফলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
এই তিনটি বিদ্যালয়ের মধ্যে বস্তাল ও শারীর ভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি দুর্গম হয়ে থাকে। আমরা এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলেছি- তারা যেন বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পাঠগ্রহণের ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সবসময় উৎসাহিত করেন। শিক্ষা কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয় সে নির্দেশনা দেয়া আছে।
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে স্থায়ীভাবে নৌকার ব্যবস্থা করা সংক্রান্ত দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে তহবিল পেলেই আমরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নৌকার ব্যবস্থা করব।’