জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সিনেটে ৩৩ জন শিক্ষক প্রতিনিধি পদে নির্বাচন সোমবার। নির্বাচনে উপাচার্যপন্থী হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ ও উপাচার্যবিরোধী হিসেবে পরিচিত শিক্ষক ঐক্যপরিষদের ব্যানারে দু’টি সংগঠন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম মতবিনিময়ের নামে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।
মতবিনিময়ে অংশ নেয়া একাধিক শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও উপাচার্যের বক্তব্য মেলেনি। আর বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নেতৃবৃন্দের দাবি, উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শিক্ষকের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৪ অক্টোবর বিকেলে নতুন প্রশাসনিক ভবনের কাউন্সিল কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন উপাচার্য। আর বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নামে ফেসবুক গ্রুপে বার্তা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের এই সভায় উপস্থিত থাকতে বলেন সংগঠনটির সদস্য সচিব অধ্যাপক বশির আহমেদ।
শিক্ষক ঐক্যপরিষদ নেতারা বলছেন, উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক মো. নূরুল আলম যে কোনো শিক্ষকের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন। তবে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সদস্য সচিব বিষয়টি সমন্বয় করায় প্রশ্ন জেগেছে। উপাচার্য শিক্ষকদের কাছে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পক্ষে ভোট চেয়েছেন বলে ধারণা করছি আমরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয় ও ট্রেজারারের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মতবিনিময় সভা হয় ১২ অক্টোবর। যদিও শিক্ষক ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এ সংক্রান্ত বার্তায় শিক্ষক সংগঠনটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষে অধ্যাপক আলমগীর কবির ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সহযোগী অধ্যাপক’ শব্দবন্ধ উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও শনিবার বিকেল ৪টায় সমাজবিজ্ঞান অনুষদের লাউঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন, হাউস টিউটর ও সহকারী হাউজ টিউটরদের সঙ্গে উপাচার্যের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নিগার সুলতানা এ সংক্রান্ত বার্তা সংশ্লিষ্টদের পাঠিয়েছেন।
ওই সভার কিছু ছবি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যসহ হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন শিক্ষকরাও সভায় উপস্থিত রয়েছেন। এ নিয়ে ‘শিক্ষক ঐক্য পরিষদ নেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলের প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন, হাউস টিউটর ও সহকারী হাউজ টিউটরদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেই পারেন। তবে এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে বন্ধের দিন মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একটি দলনিরপেক্ষ পদ। এমনকি তাকে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে কর্মকর্তা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সিনেটের সভাপতি হিসেবে তার নিরপেক্ষতা সবসময় কাম্য, বিশেষত যে কোনো নির্বাচনের সময়।
‘এখানে রিটার্নিং কর্মকর্তা উপাচার্যের অধীনে কর্মরত থাকেন এবং তার ওপর কোনো তদারককারী থাকেন না। এজন্য তার নৈতিক, ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখাটা জরুরি। অন্যথায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংকটে পড়বে।’
নির্বাচনী প্রচারবিধি নিয়ে তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ নির্বাচন কোনো ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নয়। মাঠ পর্যায়ের নির্বাচনী বিধি আর এখানকার নির্বাচনী বিধিও এক নয়। এখানে সবাই বিধিনিষেধের বাইরেও ন্যায় ও নীতিসঙ্গত আচরণ প্রদর্শন করবেন ধরে নিয়েই বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উপাচার্যের মতবিনিময় সভার বিষয়টি বিধিবদ্ধ আচরণ পরিপন্থী না হলেও নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এ বিষয়ে সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে শিক্ষক ঐক্য পরিষদের প্রার্থী ও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩’ প্রদানের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। এই মর্যাদা আমাদেরকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করেছে। এই অধ্যাদেশের সঙ্গে একটি নির্বাচনী সংবিধি থাকলেও তাতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী আচরণবিধি কেমন হবে তা উল্লেখ নেই। তারপরও সাধারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সিনেটের সভাপতি উপাচার্যের কাছে আমরা নৈতিক, ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ অবস্থান প্রত্যাশা করি।’
বিএনপিপন্থী শিক্ষক অধ্যাপক মো. শামছুল আলম বলেন, ‘নির্বাচনের আগে ছুটির দিনে হলের প্রভোস্ট, ওয়ার্ডেন, আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে উপাচার্যের মতবিনিময় সভা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
‘উপাচার্য চাইলে যে কোনো কর্মদিবসে প্রশাসনিক ভবনে মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে পারতেন। কিন্তু এভাবে ছুটির দিনে মতবিনিময় সভা আয়োজন সম্পূর্ণ নৈতিকতার পরিপন্থী, যা সুষ্ঠু নির্বাচনী চেতনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।’
এ বিষয়ে জানতে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক বশির আহমেদকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি, পরে কথা বলবো।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।