শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) শাখা ছাত্রলীগে কমিটি নেই দীর্ঘ ১০ বছর। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত নেতাকর্মীরা। তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। বার বার অশান্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস।
শাবি ছাত্রলীগে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় ক্যাম্পাসে সংগঠনে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। নেতৃত্বহীনতায় বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখা নিয়ে প্রায়ই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াচ্ছে বিবদমান গ্রুপপগুলোর নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
সবশেষ সোমবার হলের ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় শরীরে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে শাবি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর জের ধরে ক্যাম্পাসে শাহপরান হলে এক নেতার কক্ষ ভাংচুর করা হয়।
এর আগে ৩১ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শাবি ছাত্রলীগের দু’পক্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন কর্মী আহত হন। এক ছাত্রীকে নিয়ে দুই ছাত্রের তর্কের জের ধরে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে জানা গেছে।
শাবি ছাত্রলীগে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলায় জড়াচ্ছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এজন্য দীর্ঘদিন কমিটি না থাকাকে দায়ী করা হচ্ছে।
১০ বছর ধরে কমিটিহীন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটি হয়েছিল ২০১৩ সালে। ওই বছরের ৮ মে এক বছর মেয়াদি ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ারও দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৮ মে ওই কমিটিকে ১৫১ সদস্যে পূর্ণাঙ্গ করা হয়।
২০২১ সালের ১৭ জুন এই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে শাবিতে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। কমিটি না থাকায় সংগঠনে অস্থিরতা ও হতাশা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারাও।
দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে শাবি ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নেতা সজিবুর রহমান বলেন, ‘সংগঠনের জন্য আমি এতোকিছু করলাম, কিন্তু দেয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই। আমাদের তো ছাত্রত্বও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর রাজনৈতিক কোনো পরিচয়ই থাকবে না। তাছাড়া দলে শৃঙ্খলার জন্যও কমিটি প্রয়োজন।’
কমিটি না থাকায় নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না জানিয়ে শাবি ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপের নেতা মামুন শাহ বলেন, ‘কারও কোনো সাংগঠনিক পরিচয় নেই। এতে অনেকেই সংগঠনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। নতুন নেতৃত্ব না আসার হতাশায় অনেকে ক্যাম্পাসই ছেড়ে দিচ্ছে।’
জানা যায়, সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকার সময়ে শাবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্তও নেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি পরিবর্তন হয়েছে চার দফা। কিন্তু শাবি ছাত্রলীগের কমিটি আর হয়নি।
সাত গ্রুপে বিভক্ত
দীর্ঘদিন কমিটিহীন থাকার কারণে শাবি ছাত্রলীগে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। নানা গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে নেতাকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাবি ছাত্রলীগের সাতটি গ্রুপ বর্তমানে ক্যাম্পাসে সক্রিয়। এসব গ্রুপের নেত্বত্বে রয়েছেন- হাফিজ আল আসাদ, খলিলুর রহমান, সজিবুর রহমান, মামুন শাহ, মেহেদী হাসান স্বাধীন, সুমন ও তারেক হালিমী।
এর বাইরে কয়েকটি উপগ্রুপও ক্যাম্পাসে সক্রিয়।
শাবি ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কমিটি না থাকায় ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে আলাদা আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি করেছেন। পদপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পাসে গ্রুপ-উপগ্রুপের সংখ্যাও বাড়ছে।
একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয়া সজিবুর বলেন, ‘নিয়মিত কমিটি হলে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসত। একটা সাংগঠনিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা থাকত। কমিটি না থাকায় কর্মী ধরে রাখার জন্যও বিভিন্ন বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।’
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপ আছে জানিয়ে আরেক গ্রুপের নেতা খলিলুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। তাই আলাদা বলয় হতেই পারে। তবে কমিটি না থাকার কারণে গ্রুপিং বেড়েছে। সংগঠনে চেইন অফ কমান্ডও অনেকটাই নেই।’
বাড়ছে বিশৃঙ্খলা
শাবি ছাত্রলীগে দ্রুতই কমিটি আসবে- এমন ধারণা থেকে নতুন কমিটিতে পদ বাগিয়ে নিতে তৎপর বিবদমান গ্রুপগুলো। ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে তারা মরিয়া। আর এই আধিপত্যের দ্বন্দ্বে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত।
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন- এমন অভিযোগও উঠছে মাঝেমধ্যেই। গত ৬ মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে মারামারি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অন্তত ১৬টি ঘটনা ঘটেছে।
প্রশাসনিক পদক্ষেপেও অবস্থার উন্নতি নেই
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতও কমছে না।
গত ১৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের কক্ষ থেকে দুই আবাসিক শিক্ষার্থীকে গালিগালাজ ও মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল ইসলাম সীমান্ত ও তার অনুসারীরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় ৩১ আগস্ট শাহপরান হলের আবাসিক ছাত্র আজিজুল ইসলাম সীমান্তকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগ নেতা রিশাদ ঠাকুর তার কক্ষে ডেকে এনে সংগঠনের কর্মী নূর মোহাম্মদ বায়েজিদকে বেধড়ক মারধর করেন। ১৮ আগস্ট এ ঘটনা ঘটে। ২০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত রিশাদ ঠাকুরকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজীবনের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদ চৌধুরী ও ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
এ ছাড়া গত সাড়ে ৭ মাসে হলের আসন দখল ও আধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছে।
এদিকে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের ১১১ নম্বর কক্ষে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ১০ শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী র্যাগ দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ২২ মার্চ ১৬ শিক্ষার্থীকে সব হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বহিষ্কৃত ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা হলেন- আপন মিয়া, আল আমিন, পাবন মিয়া, রিয়াজ হোসেন ও আশিক হোসেন।
ব্যবস্থা নেয়ার পরও শাবি ছাত্রলীগ বার বার সংঘাতে জড়ানো প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘কোনো অভিযোগ পেলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কে কোন দলের তা আমরা বিবেচনায় নেই না। একইসঙ্গে এটাও বলতে হয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের থেকে আমাদের ক্যাম্পাস অনেক শান্ত রয়েছে।’