বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মিলনের আনন্দমেলায় নারান্দিয়া স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরা

পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানের পুরোটা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে ২০০৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মিলনে এক লম্বা পরিসরের জীবন্ত হয়ে ওঠা চিত্র প্রদর্শনী যেন চলল কক্ষটিতে। সাদাকালো থেকে ক্রমেই বর্ণিল হয়ে ওঠা অপূর্ব এক চলচ্চিত্র চলল যেন। আর তা তৃতীয় নয়ন দিয়ে প্রাণভরে উপভোগ করলেন উপস্থিত সাবেক দর্শকেরা।

নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ বিদ্যালয়। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু ১৯৫৮ সালের প্রথম দিনটিতে। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে স্কুল ঘর। পূর্বদিকে বাজার ও লোকালয়। মাঝে বিশাল খেলার মাঠ। উত্তর পাশ ঘেঁষে জনচলাচলের পথ।

স্কুল ভবন থেকে উত্তরে দৃষ্টি দিলেই সামনে বিস্তীর্ণ নিচু জলাভূমি আর সবুজে ঘেরা ফসলের মাঠ। তারই একপাশে ভীত-সন্ত্রস্ত শিশুর মতো হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যালয়টির অবস্থা আর আগের মতো নেই। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে; বদলেছে বিদ্যালয়ের চেহারাও। কালের আবর্তে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অ্যান্ড কলেজ’।

মহাকালের অমোঘ ডাকে সাড়া দিয়ে হারিয়ে গেছে বিদ্যালয়টির পুরনো অনেক ঐতিহ্য। দিন বদলের পরিক্রমায় ভোল পাল্টে হয়েছে আধুনিক। উত্তরের দিগন্ত বিস্তৃত সেই মাঠ, জলাভূমি হারিয়েছে নতুন ভবনের আড়ালে। আগের সেইসব মানুষের অনেকে হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে।

জীবনের তাগিদে এলাকা ছেড়ে অনেকেই হয়েছেন বিস্মৃত। তাদেরই অনেকেই জীবন-জীবিকাকে কেন্দ্র করে হয়েছেন রাজধানী ঢাকা বাসিন্দা। পুনর্মিলনীর ব্যানারে সেই মানুষগুলো একসঙ্গে হয়ে আবেগে ভাসলেন।

হ্যাঁ, মুছে যাওয়া দিনগুলির পিছুডাক উপেক্ষা করতে না পেরে স্মৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ঢাকায় বসবাসরত নারান্দিয়া স্কুলের বিভিন্ন ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থীরা।

শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকেই ধানমণ্ডির স্টার কাবাব হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের সম্মেলন কক্ষ পরিণত হয়েছিল স্মৃতির অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা বিশাল ব্যাপ্তির এক প্যানোরামায়।

পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানের পুরোটা জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে ২০০৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মিলনে এক লম্বা পরিসরের জীবন্ত হয়ে ওঠা চিত্র প্রদর্শনী যেন চলল কক্ষটিতে। সাদাকালো থেকে ক্রমেই বর্ণিল হয়ে ওঠা অপূর্ব এক চলচ্চিত্র চলল যেন। আর তা তৃতীয় নয়ন দিয়ে প্রাণভরে উপভোগ করলেন উপস্থিত সাবেকরা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়।

শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই সপরিবারে স্টার কাবাবে উপস্থিত হতে থাকেন বিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীরা। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে বিকেল ৪টায় শুরু হয় অনুষ্ঠান।

প্রায় ৮০টি পরিবারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানের শুরুটা হয় নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সে সময়ের শিক্ষকদের স্মরণের মধ্য দিয়ে। শ্রদ্ধেয় সেসব শিক্ষকের অধিকাংশই আজ আর বেঁচে নেই।

বরেণ্য সেই শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক প্রধান শিক্ষক জহুরুল হক, সহকারী প্রধান শিক্ষক সেকান্দার আলী ও মো. আব্দুল হামিদ, মোজাফ্‌ফর হোসেন তালুকদার, প্রধান শিক্ষক মতিয়ার রহমান, অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল খালেক, সহকারী শিক্ষক বিশ্বেশ্বর তালুকদার, মো. মকবুল হোসেন, মো. মফিজুর রহমান, মো. ফজলুল হক, রামেন্দ্রনাথ মজুমদার, মো. মোজাম্মেল হক, অধ্যক্ষ ফজলুল হক, সহকারী শিক্ষক মনোয়ার হোসেন, মৌলভী মো. জামসেদ আলী, মুজিবর রহমান, মৌলভী ওয়ারেছ হোসেন আনসারী, প্রাণগোপাল বিএসসি।

তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে দোয়া-মোনাজাত করা হয়। একইসঙ্গে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মাঝে যারা আজও বেঁচে আছেন তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়।

নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষকদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এর পর শিক্ষকদের নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাবেক শিক্ষার্থীরা তাদের স্মৃতিচারণ করেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে সবাই যোগ দেন হালকা চা-নাশতার টেবিলে।

মাঝে নামাজের বিরতি দিয়ে এরপর শুরু হয় পরিচিতি পর্ব। এই পর্বে এসে জানা যায়, নারান্দিয়া টিআরকেএন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা একেকজন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বিচারক, সেনা কর্মকর্তা, বিসিএস ক্যাডার, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, ব্যাংকার, প্রকৌশলী- একে একে উঠে আসে একেকজনের বর্ণিল কর্মজীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আর সাফল্যের চিত্র।

আলোচনা আর পরিচিতি পর্বে সাবেকরা বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের প্রিয় বিদ্যালয়ের স্মৃতিঘেরা অতীতে। আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল কারও কারও। নিঃশব্দে কারও কারও চোখের ধার বেয়ে আসে নোনা জলের স্রোত। শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎগতিতে বয়ে যাচ্ছিল রুধির ধারা। আবেগের এই বিচ্ছুরণে পরিবারের এই প্রজন্মের নবীন সদস্যদের চোখে ছিল অবাক দৃষ্টি। অনুভূতি আর বিহ্বলতার মিশেলে সে এক দেখার মতো পরিবেশ।

অনুষ্ঠানের শেষে ছিল র‌্যাফেল ড্র। পুরস্কার হিসেবে তুলে দেয়া জিনিসটির দাম ছাপিয়ে একেকটি নগণ্য উপহারও পঞ্চাশ/ষাটোর্ধ্ব মানুষগুলোর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে হয়ে উঠছিল অমূল্য। নিজেদের সন্তান, এমনকি নাতি-নাতনিদেরও অবাক করে দিয়ে তাদের সামনেই যেন চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়স কমে একেকটি শিশু-কিশোরে পরিণত হচ্ছিলেন তারা।

জীবনের রঙ্গমঞ্চে কর্মব্যস্ততা আর গম্ভীর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করা মানুষগুলো যে এতটা আমোদপিয়াসী, তাদের শিশুসুলভ হাসি আর প্রাণবন্ততা দেখে নতুন প্রজন্মের চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছিল বার বার।

পুরো আয়োজনে সবটুকু সময়েই তারা বার বার ফিরে যাচ্ছিলেন স্কুল জীবনের সেই উদ্দাম-উচ্ছল শৈশবে। গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন যেকোনো মানুষই দেখতে পারত, তাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে স্কুলের সেই দিনগুলোর স্মৃতিময় নানা ঘটনা- উত্তরের দিগন্ত বিস্তৃত সেই মাঠ, জলাভূমি আর হাওয়ায় দোল খাওয়া কচি ধানপাতার দৃশ্য। সাবেক শিক্ষার্থীরা সেসব দিনের স্মৃতি আজও বুকে লালন করেন। তাদের আলাপচারিতায় উঠে আসে তা বার বার।

র‌্যাফেল ড্রয়ের পর বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।

পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনার কেন্দ্রে ছিলেন জ্যেষ্ঠ জেলা জজ ইসমাইল হোসেন। আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা সবুর হোসেন চৌধুরী ও সহ-আহ্বায়ক সানোয়ার হোসেন। ৮০’র ব্যাচের এই সাবেকদের পরিচালনায় অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।

অনুষ্ঠানটি সফলভাবে আয়োজন ও তা সর্বাঙ্গীন সুন্দররূপে সমাধা হওয়ার পেছনে আরও অনেকের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের নাম লিখতে গেলে তালিকাটা বেশ দীর্ঘই হবে।

সব মিলিয়ে ১৯৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থী থেকে ২০০৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী- সবাই যার যার অবস্থান থেকে এই আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

এই ধরনের আয়োজন ভবিষ্যতে আরও হওয়া উচিৎ বলে অনুষ্ঠানে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ডিসেম্বরে বৃহত্তর কলেবরে ফ্যামিলি-ডে করার পরিকল্পনাও নেয়া মৌখিকভাবে।

সবশেষে ছিল ভুরিভোজের আয়োজন।

ঢাকায় এ অনুষ্ঠানে আসতে চেয়েও যাদের হতাশ হতে হয়েছে, তাদের কথা বিবেচনা করেই আরও বড় পরিসরে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন নারান্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অতীত ধারণ করে ভবিষ্যৎকে হাতে ধরে গড়ে তোলা তারুণ্যে ভরপুর একদল সাবেক শিক্ষার্থী।

এ বিভাগের আরো খবর