ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৩ আগস্ট প্রাণ হারান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র রুদ্র চন্দ্র সরকার। প্রতিষ্ঠানটিতে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে কমপক্ষে ৩১ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জবির মেডিক্যাল সেন্টারে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে আসছেন। এমন বাস্তবতায় ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে জবি প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এডিস মশা বিস্তারের পরিবেশ রয়েছে জবির বিভিন্ন জায়গায়। ছবি: নিউজবাংলা
জবির নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের পেছনে, প্রশাসনিক ভবনের পাশের ড্রেনে, বিজ্ঞান অনুষদ ও ডরমিটরির রাস্তার পাশের ড্রেনগুলোর জমে থাকা পানিতে জন্ম নিতে পারে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানের ময়লা-আবর্জনা ও প্লাস্টিক বর্জ্যে বৃষ্টির পানি জমে থাকছে।
কলা অনুষদ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন স্থানেও দেখা যায় জমে থাকা পানি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের ড্রেন ও এর পাশে জমে থাকা আবর্জনা এবং মুজিব মঞ্চের পেছনেও জমে রয়েছে পানি। এসব স্থানে জমে থাকা পানিতে সহজেই বংশবিস্তার করতে পারে এডিস মশা।
বিভিন্ন ভবনের ব্লক ও অপরিচ্ছন্ন ভাস্কর্য চত্বরেও জমে রয়েছে ময়লা পানি। এসব স্থান মশা উৎপাদনের আদর্শকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনের ড্রেনে ময়লা আবর্জনা জমে পানি আটকে আছে। ময়লা আর পানি একত্রে মিশে ড্রেনগুলোতে জমে থাকা পানি কালো রং ধারণ করেছে। এসব পানিতে উড়ছে মশা। আর ড্রেনে শ্যাওলার পাশাপাশি জন্ম নেয়া আগাছা পচে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত সাতটি স্থানের ড্রেনে জমে রয়েছে পানি, যা থেকে এডিস মশা জন্মাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থীই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে মেডিক্যাল সেন্টারে
জবির উপ-প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মিতা শবনম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ থেকে ২৮০ জনের মতো শিক্ষার্থী চিকিৎসা ও ওষুধ নিতে আসছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জনেরই ডেঙ্গু উপসর্গ থাকছে। এদের মধ্যে অনেকেই ডেঙ্গু পজেটিভ হয়ে আশপাশের হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘জ্বর নিয়ে অনেকেই আসছেন। তাদের ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই ডেঙ্গু পজেটিভ হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসে না বলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।’
কী বলছেন শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে মশা বংশবৃদ্ধির সুযোগ পেলেও প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দিনে একবার করে মশার ওষুধ ছিটানো হলেও তা যথেষ্ট নয় বলেই মশার এত উপদ্রব। এ ছাড়াও নিয়মিত ডাস্টবিন ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে না।
ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সিরাজুম মনিরা বলেন, ‘বর্তমান হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। আর এতে মশাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘এখন তো ক্লাসের মধ্যেও মশা কামড়ায়। মশার যন্ত্রণায় সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে বসে থাকাও দায়।’
গণিত বিভাগের ছাত্র চয়ন কৃষ্ণ বলেন, ‘ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। ক্যাম্পাস এখন মশাদের দখলে চলে গেছে।
‘আমাদের নিজেদের সচেতন থাকার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন মশা বংশবৃদ্ধি ঘটাতে না পারে।’
লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রী নিশাত আরা মজুমদার বলেন, ‘ঢাবির কার্জন হল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বড়। তার পরও সেখানে কোনো ময়লা-আবর্জনা থাকে না, কিন্তু আমাদের এই ছোট ক্যাম্পাসের ময়লা-আবর্জনাও ভাগাড় হয়ে পড়ে থাকছে।’
প্রশাসনের ভাষ্য
২০২১ সালের ৩১ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়ন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদেরকে আহ্বায়ক ও এস্টেট কর্মকতা মোহাম্মদ কামাল হোসেন সরকারকে সদস্য সচিব করে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রেনগুলো প্রাথমিকভাবে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিলেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের কেয়ারটেকার শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী রেজিস্ট্রার ইসমাইল হোসেন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংকট আছে। হল উদ্বোধনের পর যে কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের স্থানে নতুন নিয়োগ হয়নি।
তিনি বলেন, ‘কর্মী সংকটের পাশাপাশি ময়লা ফেলার পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রেনগুলোর ভেতর দিয়ে গ্যাস ও পানির লাইন নিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবুও আমরা নিয়মিত ময়লা পরিষ্কার করি।’
ড্রেন সংস্কারের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘ড্রেন পরিষ্কার করার কাজ পরিচ্ছন্নতা কমিটির। ড্রেন পরিচ্ছন্নতা কমিটি ও কেয়ারটেকার শাখার কাজ ড্রেন পরিষ্কার করা।
‘ক্যাম্পাসের দেয়ালঘেঁষা ড্রেনগুলো ঢেকে অনেক কর্মচারীরাই বসবাস করছেন। এ জন্য সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা কমিটির আহ্বায়ক এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল কাদের বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেয় ঢাকা সিটি করপোরেশন। সারা বাংলাদেশে ডেঙ্গুর অবস্থা এখন অনেক খারাপ।
‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাহিরে নয়। আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে আগে যে হারে ডেঙ্গু লার্ভা ধ্বংস করার জন্য ওষুধ দেয়া হতো, তার চেয়ে বেশি হারে যেন ওষুধ ছিটানো হয়, সেই কথা বলেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্লাস শেষে বিকেলে প্রতিদিন ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংস করার ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার এটাই একমাত্র মাধ্যম।’
পরিচ্ছন্নতা কমিটির সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট কর্মকর্তা ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ কামাল হোসেন সরকার বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের সহায়তায় ক্যাম্পাসে মশার লার্ভার ওষুধ দিচ্ছি এবং ধোঁয়া স্প্রে করছি। এ ছাড়া ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখার উদ্যোগ নেয়া হবে।’