জাতীয় শোক দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেই সভার বিষয়বস্তু নিয়ে বুধবার গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় শিক্ষক সমিতি।
দেখা গেছে, ২২ লাইনের এই বিজ্ঞপ্তিতে ২৫টির বেশি ভুল। ভুলের ভাগাড় এই বিজ্ঞপ্তিতে সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরও করেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বানান ছাড়াও সমাসবদ্ধ পদের অপব্যবহার, প্রয়োগগত ভুল, বাংলা বানানের অব্যবহৃত রীতি, শব্দের স্থানগত অবস্থানের হেরফের, গুরুচণ্ডালী দোষ, বাক্য গঠন আর বাহুল্যজনিত ভুল লক্ষ্য করা গেছে।
এসব ভুলের বিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদকের ওপর দায় চাপান সভাপতি নিজামুল হক ভূইয়া।
আর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বিজ্ঞপ্তিতে কিছু টাইপিং মিস্টেক আছে বলে জানালেও বানান ভুল আছে তা স্বীকার করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এসব ভুলের চেয়ে কনটেন্ট গুরুত্বপূর্ণ।’
বিজ্ঞপ্তিতে থাকা উল্লেখযোগ্য একটি বাক্য গঠনজনিত ভুল হলো- বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে, ‘... ইনডেমনিটি অধ্যাদেশেরে মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রক্রিয়া রহিতকরণ’। যদিও এটা হওয়ার কথা ছিল ‘... ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া রহিতকরণ’।
এছাড়াও বাঙালিকে লেখা হয়েছে বাঙ্গালী, শোক দিবসকে একসাথে করে লেখা হয়েছে শোকদিবস, লেখা হয়েছে ‘কালরত্রি’, ‘সকল শহীদদের’, ‘ঘন্টা ব্যাপী’, ‘হত্যাকান্ড’, ‘বিভিন্ন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সমাজতাত্বিক কারণসমূহ’, ‘একশ্রেণী সামরিক কর্মকর্তা’, ‘যুদ্ধপরাধী’, ‘অধ্যাদেশেরে’, ‘সরকার বিরোধী প্রচার,প্রচারনা’, ‘শিক্ষকসমিতি’, ‘জতির পিতা’, ‘... রাশেদ চৌধুরীসহ ও অন্যান্যরা’, ‘অতিসত্ত্বর’, ‘দাবী’, ‘ব্যতয়’, ‘প্রযোগের সুপারিশ’।
আরও যেসব ভুল লক্ষ্য করা গেছে সেগুলো হলো- ‘পরীকল্পনাকারী হিসাবে’, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’, ‘...কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’, ‘শিক্ষক মন্ডলী’, ‘বৈশিক’, ‘বাংলাদেশ বিরোধী’, ‘গুরুত্ব আরোপ’, ‘অতিসত্ত্বর’ ইত্যাদি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিগুলো কীভাবে তৈরি করা হয় জানতে চাইলে সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘আমরা শিক্ষক সমিতিতে প্রথমে নিজেরা অ্যাজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা করি। এরপর যে সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো পয়েন্ট আকারে লিখে টাইপ করে তারপর আমরা স্বাক্ষর করে মিডিয়ায় দেই।’
অর্থাৎ, আপনারাই লিখেন আর আপনারাই টাইপ করেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জি জি।’
বানান ভুলের বিষয়ে নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, ‘আমি বার বার সাধারণ সম্পাদককে বলেছি- কাউকে দেখিয়ে তারপর মিডিয়ায় দেন। কিন্তু সে তড়িঘড়ি করে দিয়ে দিয়েছে। এই কাজগুলোর কারণে তো ইজ্জত যায়।’
সাধারণ সম্পাদক ড. জিনাত হুদা বলেন, “আপনার ভুল আর আমার ভুল এক না। আপনি যদি বলেন ‘দাবী’ বানানে ‘দীর্ঘ ঈ কার’ হবে না, তাহলে আমি একমত না আপনার সাথে। আমরা আজীবন দাবী বানান ‘দীর্ঘ ঈ কার’ দিয়েই লিখে এসেছি।”
বাংলা একাডেমির অভিধানের নিয়মের কথা জানালে তিনি বলেন, ‘তাহলে ছোটকাল থেকে আমরা যে লেখাপড়াগুলো করে এসেছি সেগুলো বিসর্জন দেই?’
‘বাঙালি’ বানানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাঙ্গালী বানানে ভুল কই? আজীবন তো আমরা এভাবেই লিখে এসেছি। আপনাদের এতো সাহস আমাদের ভুল ধরতে আসেন? আমি এটাই লিখবো।’
হত্যাকাণ্ড বানানের বিষয়ে তিনি বলেন, “কই? আমি তো এই বানানে ‘মূর্ধন্য ণ’ দেখছি না। আমার সামনে বাংলা ইংরেজি অভিধান খোলা আছে। সেখানে তো আমি ‘দন্ত্য ন’ দেখছি।”
এরপর তিনি প্রমাণ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপে মোবাইলের ডিকশিনারি অ্যাপের একটি ছবি পাঠান। যেখানে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ড শব্দটি ‘দন্ত্য ন’ দিয়ে লেখা।
‘জতির পিতা’ আর ‘কালরত্রি’র বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো টাইপিং এরর। টাইপ করে আমাদের টাইপিস্টরা। তারপরও অনেক সময় পাঠানোর সময় শব্দগুলো ভেঙে যায়।’
আপনারা স্বাক্ষর দেয়ার সময় পিডিএফ কপিতে স্বাক্ষর করেন। তখন খেয়াল করেছেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি আজীবন এভাবেই ‘বাঙ্গালী’ লিখবো। ‘দাবি’ বানানে ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ দিয়েই লিখবো। আর আমরা কবে কিসের উপর সিগনেচার করি সেটা তো আপনার বিষয় না। আমরা কনটেন্ট যেটা দিয়েছি সেটা ঠিক কি না এটাই মূল বিষয়।”
এই বিজ্ঞপ্তিতে আপনি নিজে কয়টা ভুল দেখেছেন জানতে চাইলে অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘আমি তো একটাও ভুল দেখিনি। আমার কাছে কনটেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। আ-কার, ই-কার ভুল হতেই পারে। এছাড়া আরও যেসব ভুল আছে সেগুলো সিলি মিস্টেক।’
বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভার শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ই আগস্ট কালরাত্রিতে নিহত সব শহীদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সভায় শিক্ষকবৃন্দ পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করেন। সেগুলো হলো- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জাতির পিতাকে অসম্মানের অধিকার রাখেন না। এটিকে বাস্তবিক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে প্রয়োগের সুপারিশ করছি।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের অতি সত্বর দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি প্রদানে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি এবং একটি বিশেষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও নেপথ্য কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি তোলা হয়।
পাশাপাশি জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আরও যেসব প্রস্তাব পেশ করা হয় সেগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নামক কোর্সটি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে প্রবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক মোড়লদের নানামুখী অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন।