পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় যা বর্তমানে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। খিস্ট্রীয় অষ্টম শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের তথা বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।
এটি মূলত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তৎকালীন সময়ে যা পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো।
পাল সম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পণ্ডিত বিহারে কিছুদিন অবস্থান ও অধ্যয়ন করেছিলেন বলে জানা যায়।
পণ্ডিতবিহারে অধ্যাপকেরা তাদের অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসরে যেসব গান-দোহা রচনা করেছিলেন তা-ই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
পণ্ডিত বিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত থাকলেও গবেষণায় উঠে এসেছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিওরি, হাজীগাঁও, বটতলী, কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ও জুলধা এলাকাজুড়ে সপ্তম-অষ্টম শতকে পণ্ডিত বিহার নামে একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
আনোয়ারার হাজীগাঁও থেকে ৬৬টি পিতলের বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া গেলে ওই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে প্রমাণ নিশ্চিত করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়ার চক্রশালার ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। তার হিন্দু জীবনের যোগ সাধনসঙ্গিনী তিল পিষে জীবনধারণ করতেন বলে তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম গ্রহণ করেন ও পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা পরিদর্শনে পরিদর্শক দল। ছবি: নিউজবাংলা
মগধের প্রধান আচার্য নরতোপা পণ্ডিত বিহারে প্রজ্ঞাভদ্রের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে লুই পা, শবর পা, লাড় পা, অবধূত পা, অমোঘনাথ, ধর্মশ্রী, মৈন, বুদ্ধজ্ঞান পা, অনঙ্গবজ্র প্রমুখ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এবং পণ্ডিতগণ পরিদর্শক হিসেবে কিংবা অধ্যাপক হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
গবেষকদের অনুমান, বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ এই বিহারে সমবেত হয়েছিলেন বলে পণ্ডিত বিহার নামকরণ হয়েছিল।
পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্ত হওয়ার কারণ বা সময়কাল সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি।
১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সেনাপতি কদলখাঁ গাজী চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানীদের বিতাড়িত করেন ও চট্টগ্রামকে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের আওতায় নিয়ে আসেন।
১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান ও আফগান শাসনভুক্ত। ধারণা করা হয়, ওই সময়ই পণ্ডিত বিহারের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।
সর্বশেষ ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মোঘল যোদ্ধারা চাটিগাঁ দুর্গ দখল করে মগদের বিতাড়িত করেন। যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দরশহর দেয়াঙ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কালের বিবর্তনে পণ্ডিত বিহারের বিলুপ্তি ঘটে বলেই বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়।
ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষক ড. জিনবোধি ভিক্ষুর নেতৃত্বে একদল শিক্ষা অন্বেষক।
২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড় অঞ্চলে পণ্ডিত বিহারের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলেই গড়ে উঠবে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
চলতি বছরের ২ আগস্ট আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নের পাশাপাশি জাদুঘর স্থাপনের নিমিত্তে জায়গা পরিদর্শন করে গিয়েছে দেশি-বিদেশি পরিদর্শক দল।
তারা কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া নামক স্থান ঘুরে দেখেন। সেসময় বিশ্বমুড়া আরাকান রাজা রাজ বিক্রমের বাড়ি ছিল বলে জানান তারা।
পরিদর্শন দলে ছিলেন পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যেক্তা ড. জিনবোধি ভিক্ষু, বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যেগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা, জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, জাপানি নৃতাত্তিক হেনরি হিরোশে ও হিরোকো হিরোশে।
এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশীদ।
শনিবার আবারও পরিদর্শক দল আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়েরর জন্য নির্ধারিত ৫০ একর জমি পরিদর্শন করে এসেছেন।
এদিন দুপুরে তারা উপজেলার বটতলী মৌজার ওই স্থানটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন আনোয়ারার ইউএনও মো. ইশতিয়াক ইমন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বশির আহমেদ, বান্দরবান বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রভাষক সুমদত্ত বড়ুয়া, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী আশিক আরেফিন ও মো. রাসেল প্রমুখ।
ঐতিহাসিক পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, ‘বাংলা ভাষার হারিয়ে যাওয়া আদি চর্যাপদের স্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন বাংলার বিদ্যাপীঠ পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃস্থাপিত করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আমাদের সঙ্গে কাজ করছে একটি গবেষক দল। এটি পুনঃস্থাপিত হলে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের শিক্ষার মানচিত্র বদলে যাবে।’
পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন নাগরিক উদ্যেগের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা বলেন, ‘অষ্টম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সক্রিয় ছিল। এটা কীভাবে ধ্বংস হলো, তা তুলে আনার চেষ্টা করছি।
‘২০১২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাশ হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুমোদন হয়েছে। এর পরও এটি কেন থেমে আছে, তা বোধগম্য নয়। আপনারা জানেন, ইতোমধ্যে জায়গা অধিগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে গবেষক দলের পাশাপাশি স্থানীয়দেরও তৎপরতা প্রয়োজন।’
সবার আশা, শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত সিদ্ধান্ত পেয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে প্রতিষ্ঠিত হবে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়। আর এটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাবে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এতে ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস। সেইসঙ্গে বদলে যাবে এ জনপদের চালচিত্র।