বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অধীনস্ত বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, নরসিংদীর অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষায় নানামুখী অনিয়মের অভিযোগ তোলায় প্রতিষ্ঠানটি একজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষায় স্বজনপ্রীতি, তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ভাইভা বোর্ডে বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখা ও নির্বাচিত প্রার্থীর সহকর্মীর মাধ্যমে খাতা মূল্যায়নসহ নানা অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষক হলেন মো. মাহমুদুল আলম সরকার। তিনি বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ও রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
ভুক্তভোগীর দাবি, লিখিত অভিযোগের প্রতিকার না পেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করায় আগের তারিখ উল্লেখ করে তাকে বহিষ্কার দেখানো হয়েছে। আর তিনি বহিষ্কারাদেশের চিঠি পেয়েছেন অনেক পরে।
জানা যায়, ২২ ডিসেম্বর ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হবে মর্মে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পদে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং বয়স অনূর্ধ্ব ৪০ বছর হতে হবে।
৮ এপ্রিল ঢাকায় লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে চারজন প্রার্থীকে ভাইভার জন্য মনোনীত করা হয় এবং পরদিন ঢাকায় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর ৯ এপ্রিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একজন প্রার্থীকে নিয়োগদানের জন্য চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়।
এ ঘটনার পর ১০ এপ্রিল ভুক্তভোগী পরীক্ষা প্রার্থী বাছাইয়ে অসংগতির উল্লেখ করে ফল পুনঃবিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও অতিরিক্ত সচিব মো. ইউসুফ আলী বরাবর আবেদন করেন। পরে তিনি ১৬ এপ্রিল পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একই বিষয়ে অবহিত করে চিঠি দেন।
আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, অধ্যক্ষ পদটি রাজস্ব খাতে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী তৃতীয় গ্রেডের উচ্চতর পদ। কিন্তু ভাইভাতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকা তিনজনের মধ্যে দুই জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। ওই দুইজনের মধ্যে একজন আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক, যা ওই অধ্যক্ষ পদের কয়েক ধাপ নিচের পদ।
অন্যদিকে মেধাক্রম অনুসারে প্রথম হিসেবে নির্বাচিত প্রার্থীর সহকর্মী ভাইবা পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং খাতা মূল্যায়নে স্বজনপ্রীতি ও ভাইভাতে একপাক্ষিক আচরণ করেন। নির্বাচিত প্রার্থী রোল ক্রম অনুযায়ী নাম ঘোষণার ৪৫ মিনিট পর হাজির হয়েছেন, যা ওই অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে।
লিখিত অভিযোগ আরও বলা হয়, যাকে চূড়ান্ত মনোনয়নে দ্বিতীয় করা হয়েছে, তার শিক্ষা জীবন শেষ হয়েছে মাত্র ১১ বছর আগে। সে হিসেবে আবেদনের শর্ত পূরণ করেও তিনি লিখিত পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হয়েছেন।
এসবের উল্লেখ করে মাহমুদুল আলম সরকার প্রার্থী বাছাইয়ে অসংগতি ও ত্রুটি থাকায় ফল পুনঃবিবেচনার অনুরোধ জানান। তাতেও কোনো ফল না হওয়ায় ভুক্তভোগী ২৭ এপ্রিল উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন।
এদিকে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন না দেয়ার অভিযোগ তুলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ও পরিচালক (প্রশাসন) ১২ এপ্রিল ওই শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। তাতে বলা হয়, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় আপনার বিরুদ্ধে কেন পদক্ষেপ নেয়া হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষক ২৫ এপ্রিল কারণ দর্শানোর অভিযোগের লিখিত উত্তর দেন এবং ২৭ এপ্রিল উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন। এরপর ২৭ এপ্রিল তারিখ দিয়ে ওই শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কার করে আদেশ দেয়া হয়।
ভুক্তভোগীর আইনজীবী মুনতাসির মাহমুদ রহমান এ বিষয়ে মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাদেরকে ভাইভা বোর্ডে রাখা হয়েছে তারা প্রার্থীর চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন। তাছাড়া যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে তার সহকর্মীরা তার খাতা মূল্যায়ন ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন। এজন্য আমার মোয়াক্কেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অনেক অনিয়মের সুযোগ ছিল। আরও অনেক বিষয় রয়েছে প্রমাণসাপেক্ষ। আমরা রিট পিটিশন দায়ের করেছি, আমরা আশাবাদী ন্যায়বিচার পাব।’
এসব বিষয় জানতে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) সুকুমার চন্দ্র সাহাকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘আপনার অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আপনার কিছু জানার থাকলে অফিসে এসে লিখিতভাবে জানান। লিখিত ছাড়া আমি উত্তর দেব না। তাছাড়া আমি নিজে থেকে কিছু করি না, বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে কাজ করি।’
নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউসুফ আলী জানান, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ পরীক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করার অভিযোগে মো. মাহমুদুল আলম সরকারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এখানে আমরা স্বচ্ছভাবে নিয়োগ দিয়েছি। কোনো স্বজনপ্রীতি করা হয়নি। সে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে।’
দেশে টেক্সটাইলের অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও তিনজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে দু’জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত করা হয়েছে কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা বুটেক্স (বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে একজন নিয়েছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থাকতে পারবে না এমন কোনো কথা নেই।’
অধ্যক্ষ পদ থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধানকে পত্র দিয়েছিলাম। তিনি ওই ব্যক্তিকে ভাইভা বোর্ডে পাঠিয়েছেন। ওখানে আমাদের হাত নেই।’
প্রথম হওয়া প্রার্থীর সহকর্মীকে দিয়ে খাতা মূল্যায়ন এবং তাকে ভাইভা বোর্ডে বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাখা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে চিঠি দিয়েছি। তিনিই ওই শিক্ষককে নিয়োগ বোর্ডে পাঠিয়েছেন। এখানে স্বজনপ্রীতি হয়নি। আর কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ভাইভা বোর্ডে থাকতে পারবেন না, এমন কোনো কথা নেই।’
পরীক্ষায় দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীর অভিজ্ঞতা ১২ বছর না হলেও তার পরীক্ষা নেয়া ও নির্বাচিত করার কারণ জানতে চাইলে মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘ওই প্রার্থীর ১২ বছরের অভিজ্ঞতা হয়নি তা ঠিক আছে। কিন্তু তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাই অভিজ্ঞতা দুই বছর বেশি ধরা যায়।’