২০২৩ শিক্ষাবর্ষের নবম-দশম শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য নির্বাচিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ ও গণহত্যা’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে।’ বইতে ২৫ মার্চের কালরাতের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরে এক বর্বর গণহত্যা চালায়।
নতুন শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে এ রকম বেশ কিছু তথ্যগত ভুল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বেশির ভাগ ভুল ইতিহাসকেন্দ্রিক। কিছু বানান ও যতিচিহ্ন সংক্রান্ত ভুলও আছে। তবে এনসিটিবি বলছে, এগুলো বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন। তারাই পরিমার্জন করেছেন। এখানে এনসিটিবির দায় নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনসিটিবি তাদের দায় এড়াতে পারে না।
নবম শ্রেণির এই বই রচনা করেছেন বলে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হলেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম, অধ্যাপক ড. সুলতানা নিগার চৌধুরী ও অধ্যাপক প্রদ্যুত কুমার ভৌমিক। এ ছাড়া সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ইতিহাসবিদ এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক তাসলিমা বেগম।
গণহত্যার তারিখ ২৫ না ২৬ মার্চ জানতে চাওয়া হলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন এই ভুলের কথা বলা হয়, তখন যিনি সম্পাদনা করেছেন তিনি জানাচ্ছেন যে, তিনি (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান) পাকিস্তানে পৌঁছানোর পরে টিক্কা খান অপারেশন সার্চলাইটের আদেশ দেন। ১১টা ৪০ মিনিটে তিনি (ইয়াহিয়া) ঢাকা থেকে বিমানে ওঠেন। এর মানে এই অপারেশন ১২টার পরে শুরু হলে তা ২৬ তারিখ হয়।’
তবে ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘২৫ মার্চ যেভাবে জেনে আসছি, সেটিই। তাই আমরা এখন কোনো কিছুই করতে পারছি না। আমরা ১২টা ১ মিনিটে ২১ ফেব্রুয়ারির ফুলের মালা দিই। তাই এইগুলো যদি ধরা হয়, তাহলে দ্বিধায় পড়ে যাব। তার পরও আমরা বিশেষজ্ঞকে বলেছি।’
এর আগে ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরে পাঠ্যবইয়ে ভুলের কারণে সে সময় (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান এবং সদস্যকে (কারিকুলাম) তলব করে হাইকোর্ট। তখন ভুলগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিয়ে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. আলমগীর আলম পাঠ্যপুস্তকের ভুলের বিষয়ে রিট আবেদন করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও সদস্যকে তলব করা হয়।
পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনার সঙ্গে কয়েক বছর ধরে জড়িত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৬ মার্চ থেকে গণহত্যা হয়েছে এটা ভুল। ওটা আসলে ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে শুরু হয়েছে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের আগে তিনি অয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে স্বাধীনতার বার্তা পাঠান।’
ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘উনি (বঙ্গবন্ধু) সাড়ে ১২টার সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন আর আক্রমণ শুরু হয়েছে রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে। তখন তো ২৫ মার্চ।’
রাজারবাগ পুলিশ ‘ক্যাম্প’, ইপিআর ‘ক্যাম্প’
নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্য বই বিজ্ঞান শাখার জন্য নির্বাচিত ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’-এর ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ২৫ মার্চের গণহত্যার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায়।’ এই একই তথ্য ছিল গত বছরের বইয়ে, যা ভুল হিসেবে তখনই গণ্য হয়েছিল। এখানে তথ্যগত ভুল হলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসকে পুলিশ ‘ক্যাম্প’ এবং পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরকে ‘ক্যাম্প’ লেখা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছেন কে?
একই শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য নির্বাচিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বইয়ের ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ‘১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।’ এটিও সঠিক তথ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শপথ পড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আর এই শপথ পড়ানোর খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয় সে সময়ের বিভিন্ন দৈনিকে। সে সময়ের জাতীয় দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান শিরোনাম ছিল : ‘বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ: বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী’। সেখানে শপথ অনুষ্ঠানের যে ছবি ছাপা হয়, তাতেও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে দেখা যায়।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আপনি যদি এক লাইনের কথা বলেন তাহলে ভুল। আর আগে-পিছে মিলিয়ে ন্যারেটিভ আমরা দেখেছি। এর মধ্যে একটা ভুলকেই ভুল হিসেবে দেখা হচ্ছে আর সেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শপথ পড়ানোর নাম নিয়ে।’
চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা হারুন স্যারের (অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ) মতামত নিয়েছি। হারুন স্যার বইটির সম্পাদক ছিলেন। স্যার ফোন ধরেই বলেন, কারে দিয়ে বই লেখান? তখন বললাম স্যার আপনিই তো ছিলেন সম্পাদক। আমি তো চেয়ারম্যান আর আমি তো বই লিখি না।’
এই ভুল নিয়ে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যাদের দিয়ে লিখিয়েছি, আপনি তাদের প্রোফাইল দেখেন। যাদের দিয়ে যৌক্তিক মূল্যায়ন করেছি, তাদের প্রোফাইল দেখেন। যাদের দিয়ে পরিমার্জনা করালাম, তাদের প্রোফাইল দেখেন। সব হাই ক্লাস লোক। এখানে ভুল হলে আমাদের কী করার?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভুল বের হওয়ার পর সম্পাদক যিনি ছিলেন, তাকে টেক্সট পাঠানো হলে তিনি কিছু জিনিস জানিয়েছেন। এনসিটিবি সেগুলো পর্যালোচনা করছে। এরপর আরও কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হবে। যদি তারা বলেন ভুল হয়েছে, তাহলে তা পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শপথ পড়ানো নিয়ে যেটি ছাপা হয়েছে, সেটি ভুল। এটা তথ্যগত ভুল।’
তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ১২ জানুয়ারি অপরাহ্নে মানে দুপুর ১২টার পরে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেছেন। তার আগে বঙ্গবন্ধু যেহেতু মুজিবনগর সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাই ১১ তারিখ তিনি একটি প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার দিয়েছিলেন। সেই অর্ডারে বলেছেন, আমাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে এবং সংসদ না বসা পর্যন্ত মন্ত্রণালয় একজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করবেন ও একজন বিচারপতি নিয়োগ করবেন। ওই বিচারপতির কাছ থেকে শপথ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আবু সাঈদ তখন প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। তখন বঙ্গবন্ধু শপথ নিয়েছেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছ থেকে। ১১ তারিখ এসব ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন। ১২ তারিখ তা কার্যকর হয়েছে। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে নিয়োগ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।’
আরও যেসব ভুল
নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে (পৃষ্ঠা-১) ‘অংশগ্রহণের’ বদলে ‘অংশগ্রহনের’ ছাপা হয়েছে। ‘ছিল না’র বদলে ছাপা হয়েছে ‘ছিলনা’। এই বইয়েও কোলনের ব্যবহার বেশির ভাগই ভুল। বেশির ভাগ পাঠ্য বইয়ে হাইফেন, ড্যাশ ও কোলনের ব্যবহার যথাযথ হয়নি।
নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ বিষয়ের ১১ পৃষ্ঠায় বলা হচ্ছে, ১৬৭ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ অর্জন করে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি আসন হলে তাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলা হয়।
একই শ্রেণির ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা’ তৃতীয় অধ্যায়ের (পৃষ্ঠা-২৫) শুরুর দিকেই একাধিক জায়গায় ‘সময়কাল’ শব্দ উল্লেখ আছে। সময় ও কাল দুটি শব্দ, তবে একই অর্থ। তাই যেকোনো একটি ব্যবহৃত হবে। একই পৃষ্ঠায় এক জায়গায় আছে ‘নদ-নদীগুলো’। ‘নদনদী’ শব্দটিই বহুবচন। আরেক জায়গায় ‘কোনো দেশের’ বদলে ‘কোন দেশের’ ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া যতিচিহ্ন কোলনের ব্যবহার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক হয়নি। কোনো কোনো বইয়ে ‘পরিপ্রেক্ষিত’ শব্দের বদলে একই অর্থে ‘প্রেক্ষিত’ ছাপা হয়েছে।
একই বইয়ের ২০৩ পৃষ্ঠায় ‘সংবিধানের বৈশিষ্ট্য’ অনুচ্ছেদে এক জায়গায় আছে ‘পঞ্চমভাগে জাতীয় সংসদ’। এটি হবে ‘পঞ্চমভাগে আইনসভা’।
কী করবে এনসিটিবি
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেসব ভুল পাব, তা রেকটিফিকেশন লেটার (সংশোধনী চিঠি) দিয়ে প্রতিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠাব। ওনাদের বলব, সেগুলো প্রিন্ট করে প্রতিটি স্কুলে দিয়ে দিতে, যাতে শিক্ষকরা পড়ানোর সময় ঠিক করে পড়ান।’
প্রতিবার ভুল থাকার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি আমাদের এনসিটিবির কেউ দায়ী থাকেন, তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। মন্ত্রণালয়ের কাছে তার শাস্তির সুপারিশ করা হয়। তবে বাইরের কিছু হলে এই দায়িত্ব তো আমার মধ্যে পড়ে না। আমরা সেটি জানাতে পারি। পরে সংশোধন করতে পারি।’
অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যাদের জড়িত রেখে দেখানোর (সম্পাদনা) দরকার, যাদের নিষ্ঠা আছে, ভালোবাসা আছে, দরদ আছে, সেগুলো না করে কতগুলো ভাড়াটে লোক দিয়ে দেখায়, যারা পয়সা পায়। এখান-ওখান থেকে নিয়ে লেখে। কেউ সিরিয়াসলি নেয় না।’
এনসিটিবি দায় দিচ্ছে সম্পাদনা ও পরিমার্জনার সঙ্গে জড়িতদের। সেই বিষয়ে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমাকে ফোন করেছিল, আমি তো সব দিয়ে দিয়েছি, বই সহকারে রেফারেন্স দিয়ে। এই দায় তো এনসিটিবির। এটা অমার্জনীয় ভুল আর এটার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এনসিটিবিকেই।’