আর কদিন পর আসছে নতুন বছর। প্রথম দিনে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে উন্মুখ বিদ্যালয়পড়ুয়া লাখো শিক্ষার্থী। তবে ১ জানুয়ারি তারা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভিড় জমালেও তাদের মধ্যে ভর করবে অপূর্ণতা। বই উৎসবের জন্য সরকারের সব প্রস্তুতি থাকলেও দেশের সব শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সব বই তুলে দিতে সময় লাগবে অন্তত আরও তিন থেকে চার মাস।
শিক্ষার্থীদের হাতে বই যেমন দেরিতে পৌঁছাবে, তেমনি এবারের পাঠ্যপুস্তক পুরো শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত টিকবে কি-না তা নিয়েও আছে সংশয়। কারণ কাগজ সংকটে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানো হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক।
মাঠ ঘুরে এসব তথ্যের নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও এসব অভিযোগ মানতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, তাদের কাছে মাধ্যমিক স্তরের বই প্রস্তুত আছে ৭৮ ভাগ ও প্রাথমিক স্তরের ৬৯ ভাগ। আগামী তিন দিনে তারা সব মিলিয়ে ৮০ ভাগ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে পারবেন। ১ জানুয়ারি এসব সংকট কাটিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বই সরবরাহ করতে প্রস্তুত আছেন তারা।
কর্তৃপক্ষের এমন বয়ানের সঙ্গে অবশ্য ছাপার কাজে জড়িত ব্যবসায়ীদের কথার মিল নেই। মুদ্রণকারীরা জানিয়েছেন, আলাদা আলাদাভাবে এখনও প্রায় ৫৬ শতাংশ বই ছাপানোর কাজ বাকি। অথচ নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে মাত্র বাকি তিন দিন। এই অবস্থায় এবারও ১ জানুয়ারি সব শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সব বই দেয়া সম্ভব হবে না। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী বই পৌঁছাতে সময় লাগবে অন্তত মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত।
কত বই ছাপা হয়েছে?
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৬ হাজার ৯২৩ কপি পাঠ্যবই ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এগুলোর মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮টি এবং মাধ্যমিক স্তরে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৪৫টি পাঠ্যবই ছাপানো হবে।
এনসিটিবি বলছে, এর মধ্যে প্রাথমিকের জন্য ৬ কোটি ৬৬ লাখ ১৯৫টি বই সরবরাহ করা হয়েছে। তবে মুদ্রণ সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য মতে, ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮২ হাজার বই প্রস্তুত হয়েছে। অন্যদিকে, এনসিটিবির পক্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার বই প্রস্তুত থাকার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সংখ্যা ১৪ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার।
দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ২০১০ সাল থেকে বিনামূল্যে নতুন বই দিয়ে আসছে সরকার। তবে বইয়ের নিম্ন মান নিয়ে প্রতিবারই অভিযোগ ওঠে। এবারও এই অপবাদ ঘুচবে না। মুদ্রণ ব্যবসায়ী ও এনসিটিবির সূত্র জানায়, কাগজ সংকটে ৮৫ জিসিএম কাগজের পরিবর্তে এবার সাধারণ নিউজপ্রিন্টে চলছে বই ছাপানোর কাজ।
মুদ্রণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানো হয়েছে ৫০ ভাগ। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য ৬০ ভাগ ও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য ৪০ ভাগ। অন্যদিকে, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপানো হয়েছে ৩০ ভাগ।’
মুদ্রণ সমিতির তথ্য মেনে নিতে আপত্তি করছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওনাদের তথ্য সাংঘর্ষিক। আমাদের কাছে বই পৌঁছে দেয়ার চালান রয়েছে। সেই অনুযায়ী আমরা মাধ্যমিকের জন্য ৭৮ ভাগ বই প্রস্তুত করেছি আর প্রাথমিকের জন্য ৬৯ ভাগ বই প্রস্তুত করে পৌঁছে দিয়েছি।’
১ জানুয়ারির বই উৎসবের মধ্য দিয়ে সব শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার যে সংস্কৃতি সরকার চালু করেছে, তার সফলতা নিয়ে পূর্ণ আশাবাদি এই কর্মকর্তা।
ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আশা করি পুরোপুরি বই পাবে শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিকে একটু এদিক-ওদিক হতেও পারে আবার নাও পারে। মাধ্যমিকে সব বই পাবে। দেশের সব জায়গায় বই যেতে জানুয়ারির ১৫ তারিখ লাগবে। উৎসব হওয়ার মতো বই আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’
ফরহাদুল ইসলাম যুক্তি দিয়ে বলেন, বছরের প্রথম দিন বই দেয়া হলেও সবার পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘আমার ৮০ ভাগ বই ওইদিন চলে যাবে। মাধ্যমিকে ৭৮ ভাগ বই চলে গিয়েছে। প্রাথমিকে ৬৯ ভাগ বই চলে গিয়েছে, গতকালের (সোমবার) রিপোর্ট পর্যন্ত। আমরা এই কয়দিনে মাধ্যমিক বাদ দিয়ে প্রাথমিকের বইটা দিতে বলেছি। বই প্রস্তুত হয়ে আছে এখন মাঠে দেয়া নিয়ে কথা। আমরা চাই ১ তারিখে ৮০ ভাগ বই পৌঁছে যাক।’
বইয়ের মান নিয়ে আপস এনসিটিবির
পাঠ্যবই ছাপাতে যে মানের কাগজ ব্যবহারের শর্ত দেয়া হয়েছে, কাগজ সংকটের অজুহাত দিয়ে তা রাখছে না মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। শুরুতে বিষয়টি এনসিটিবির নজরে আনা হলে তারা হাঁকডাক দিলেও, এখন নমনীয় সুর।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেরি করে দরপত্র দেয়া ও কাগজ সংকটের কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। কাগজের উজ্জ্বলতার মান ৮৫ একক রাখার শর্ত ছিল কার্যাদেশে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে নিউজপ্রিন্ট। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এই শর্তে নমনীয় হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি।
নমনীয় হওয়ার পর কথার ধরনও পাল্টে গেছে এনসিটিবির। ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভার্জিন পাল্প (কাঁচা মণ্ড) না দিলে উজ্জ্বলতা আসবে না। আমরা ৮৫ ব্রাইটনেস চাই। তবে এই চাওয়াটাও আমাদের ঠিক না। বাচ্চাদের চোখের জন্য এটা ঠিক না। আমরা কাগজের মান ভালো রাখতে উজ্জ্বলতা বেশি চেয়েছি। তবে আমাদের ভার্জিন পাল্প না থাকার কারণে এটা হয়েছে।’
উজ্জ্বলতা ছাড়া কাগজের অন্য কোনো মানের সঙ্গে আপস করা হয়নি বলে দাবি করেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি কাগজের বাকি সব প্যারামিটার ঠিক রেখে যেটুকু করা যাবে সেটাই হবে। অনেকেই এটা সুযোগ হিসেবে নিয়ে নিউজপ্রিন্ট ব্যবহার করেছে। তবে আমরা অনেক প্রেসের কাজ, কাগজ ও ফর্মা বাদ দিয়েছি।’
মুখোমুখি মুদ্রণ সমিতি ও এনসিটিবি
বই ছাপানো নিয়ে শুরু থেকেই দুই ধরনের বক্তব্য দিয়ে এসেছে এনসিটিবি ও মুদ্রণ সমিতি। ব্যবসায়ীদের দাবি, সব সংকটের কারণ সরকারপক্ষের দরপত্র আর কার্যাদেশ দিতে দেরি করা। সময় থাকতে এসব কাজ সম্পন্ন হলে, শেষ সময়ে এসে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
এনসিটিবি নিজেদের ঘাড়ে দায় নিতে নারাজ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করেই সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করছে। কারণ নিজেদের গুদাম থেকে পুরনো কাগজ দিয়েও তারা চায় ঠিক সময়ে বই আসুক।
মুদ্রণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাস্তবতা ভিন্ন। কাগজের যে সংকট সেটি তো নিরসন হয়নি। উল্টো আরও সংকট তৈরি হয়েছে। তারা অর্ডার করেছিল ৮৫ মানের ব্রাইটনেসে। আর বই নিচ্ছে নিউজপ্রিন্টে। আমরা আগেই বলেছিলাম যে কোনো একটাতে অর্ডার করেন। তখন আমাদের কথা শোনেনি তারা। এখন মেনে নিয়েছে।’
জহুরুলের মতে ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করে জুনে কার্যাদেশ দিলে কোনো ঝামেলা তৈরি হতো না। তিনি বলেন, ‘অর্ডার দেয়া হয়েছে অক্টোবর থেকে। আর নভেম্বরের ৩ তারিখে শেষ অর্ডার হয়েছে। যখন ডিসেম্বরে বই দরকার, তখন ছাড় দিয়ে নিউজপ্রিন্টে বই নেয়া হচ্ছে।’
এমন সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কার কথা আরও চার মাস আগে মন্ত্রণালয়ে লিখিত জানানো হয়েছে বলেও দাবি করেন জহুরুল। তিনি বলেন, ‘তখন কোনো সমাধান দেয়া হয়নি। তখন কেউ শোনেনি।’
ব্যবসায়ীদের এমন তথ্য শুনে বেজায় চটে যান এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি এটা তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি যে আপনারা কাদের নেতা? আপনারা যাদের নেতা তারা আমাদের বই দিয়ে দিল। আর আপনারা কী তাদের অস্বীকার করছেন? আপনারা এভাবে কেন কথা বলছেন?’
অনেক ব্যবসায়ী উপজেলা পর্যায়ে বই পৌঁছে দিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। ফরহাদ বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে আমার বই পৌঁছে দিয়ে তো আমাকে চালান দিয়েছে। আমার কাছে রেকর্ড আছে। আপনারা বলছেন ৩০ ভাগ বই দিয়েছে। সেটা আপনারা এনসিটিবির সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থে বলতে পারেন। কিন্তু বই তো আপনাদের প্রেসের লোক বানিয়ে দিয়েছে।’
ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘মুদ্রণ সমিতি চাচ্ছে আমরা ব্যর্থ হই। দেশে কাগজ নেই তাদের কাগজ আমদানি করতে দিতে হবে। আমি শুধু জানি, আমার বই দিতে হবে। আমি মুদ্রণ সমিতির কথায় কান দিচ্ছি না। এবার শুধু কাগজের সংকট। আমার গোডাউনের পুরোনো কাগজ দিয়েছি। সেখানে ১০০ টনে ৮০ টন হয়। এটা তো আমাদের কাজ ছিল না। আমরা জানি কারা কী অবস্থায় আছে। আমরা দিচ্ছি। আমার তো টেন্ডার দিয়ে এই দায় নেয়ার কথা না।’
দরপত্র আহ্বান ও কার্যাদেশ নিয়ে ব্যবসায়ী অভিযোগকেও আমলে নিতে নারাজ ফরহাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তবে নভেম্বরে অর্ডার হয়েছে আর দেরিতে হয়েছে এটা তাদের বাহানা। আমরা তাদের ক্যাপাসিটি জেনে গিয়েছি। তারা ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার দিতে চায় না। তাদের মানসিক সমস্যা আছে।’