বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নতুন ক্যাম্পাস হবে, হল উদ্ধারে গা নেই জবি প্রশাসনের

  •    
  • ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৬:১০

কেরানীগঞ্জের তেঘোরিয়ায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ চলছে। এ কারণে পুরান ঢাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আসাবিক হলগুলোর দখল ফিরে পেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পার করার পর একমাত্র ছাত্রী হল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে অনাবাসিক তকমা মুক্ত হলেও এখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বেদখল হয়ে থাকা ছাত্র হলগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।

তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে হলগুলো প্রভাবশালীদের দখলে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালালেও হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নতুন ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ফলে বেদখল হল উদ্ধারে আর আগ্রহ নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

আবাসিক হলের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০০৯, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে আন্দোলনে নামেন। এসব আন্দোলনে পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষে আহত হন বহু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অনেকে পুলিশের হাছে আটক হয়ে কারাবরণ করেন।

২০১১ সালে হল আন্দোলনের পর ছাত্রী হল নির্মাণের ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পরবর্তীতে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগার কেরাণীগঞ্জে স্থানান্তর করা হলে সেই জায়গায় আবাসিক হল নির্মাণের দাবিতে ২০১৬ সালে আবারও আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন বড় আকার ধারণ করলে কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জায়গায় নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের ঘোষণা দেয় সরকার।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে গোপীমোহন বসাক লেনে ‘শহীদ নজরুল ইসলাম হল’ এর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্র বসবাস করছেন। ছবি: নিউজবাংলা

কেরানীগঞ্জের তেঘোরিয়ায় বর্তমানে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ চলছে। বর্তমানে ধীরগতিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ চললেও মাস্টারপ্ল্যানেই আটকে আছে মূল ক্যাম্পাসের কাজ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করার জন্য পাঠানো হলেও এখনও সাড়া না মেলায় আর কোনো অগ্রগতি নেই এই কাজের।

নতুন ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর বেদখল হলগুলোর বিষয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। ২০২০ সালের অক্টোবরে একমাত্র ছাত্রী হল উদ্বোধন ও চলতি বছরের মার্চে সেখানে ছাত্রী তোলার পর আবারও আলোচনায় উঠে আসে বেদখল হয়ে যাওয়া ছাত্রহলগুলো।

স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস শুরু করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেই সময়ের ছাত্রনেতারা এগুলোকে ছাত্রাবাসে পরিণত করেন। বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা কলেজের অধ্যক্ষদের নামে নামকরণও করা হয় হলগুলোর।

দখলদারদের প্রথম দৃষ্টি পড়ে আরমানিটোলার শহীদ আব্দুর রহমান হলের ওপর। স্বাধীনতার পরপরই দাতব্য প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম একাধিকবার এই হলের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। সে সময়ে শিক্ষার্থীরা সেটিকে রক্ষা করে। তবে ১৯৮৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয়দের সাথে এই হলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আটটি হল বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে কলেজ সংলগ্ন শহীদ আজমল হোসেন হলটিও দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

১৯৮৮ সালের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার কেরানীগঞ্জে জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের ‘রানা হল’ নামে একটি ছাত্রাবাস ছিল। সেটাও দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির নামে যে সকল আবাসিক হল রয়েছে, বেশিরভাগই স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছে। অনেক হলের কাগজপত্রও নিজেদের নামে করে নিয়েছে তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের স্থানে ‘মাহমুদা স্মৃতি ভবন’ নামের ছাত্রদের একটি হল ছিল। প্রতিষ্ঠানটির পুরাতন বিভিন্ন ছবিতেও হলটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ‘এরশাদ হল’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হল বর্তমানে কলা অনুষদের একাডেমিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলগুলোর মধ্যে ৩৫ ও ৩৬ প্যারিদাস রোডের ১ নম্বর ঈশ্বরচন্দ্র দাস লেনে ১০ কাঠা জমির ওপর বাণী ভবনের কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেলেও এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা সিংহভাগ দখলে রেখে সেখানে বসবাস করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার পর ২০১১ ও ২০১৪ সালে হলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে গোপীমোহন বসাক লেনের ‘শহীদ নজরুল ইসলাম হল’ ও মালিটোলায় অবস্থিত ‘ড. হাবিবুর রহমান হল’ উদ্ধার করা হয়। এগুলোকেও বসবাস উপযোগী করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

২০১৪ সালে আরমানিটোলার আব্দুর রহমান হল ইজারা পায় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী সেখানে থাকেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি কর্মকর্তা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী বিলুপ্ত কলেজের সব সম্পত্তির হিসাব পেতে মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ফার্মটির অনুসন্ধানে তৎকালীন কলেজের ১২টি হল ছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে আরমানিটোলার এসি রায় রোডে আবদুর রহমান হলটি এখন পুলিশ সদস্যদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদুনাথ বসাক লেনের সাইদুর রহমান হল ও টিপু সুলতান রোডের রউফ মজুমদার হল দুটির বর্তমানে কোনো অস্তিত্বই নেই। আরমানিটোলার মাহুতটুলির ১ নম্বর শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী রোডের ৪০ কাঠা জমিতে শহীদ আনোয়ার শফিক হলটি স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছে।

পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেইনের ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠার উপর তিব্বত হলটি দখলে নিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ হাজী সেলিম। ২০০১ সালে হলটির স্থানে স্ত্রীর নামে ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ নির্মাণ করেন তিনি। প্রতিবাদে কয়েক দফা আন্দোলনেও নামেন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা।

পাটুয়াটুলীর ১৬ ও ১৭ নম্বর রমাকান্ত নন্দী লেনের শহীদ আজমল হোসেন হল দখলে নিয়ে পুলিশ সদস্যদের পরিবার থাকত। তাঁতীবাজারের ঝুলনবাড়ী লেনে শহীদ শাহাবুদ্দিন হল দুই যুগেরও বেশি সময় পুলিশের দখলে ছিল। ২০০৯ সালের জুনে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল হক এর দখল নেন।

বংশালের ২৬ নম্বর মালিটোলায় বজলুর রহমান হলের ভবনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পাটুয়াটুলীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ছয়তলা আবাসস্থল দখলে নিয়ে গড়ে উঠেছে ক্রাউন মার্কেট।

এর আগে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে নীতি-নির্ধারক মহলের টনক নড়ে। সেই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসের মধ্যে ১২টি হল ও বেদখল হওয়া অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধারে সুপারিশ করতে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ২০০৯ সালের মার্চে পাঁচটি হল (আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল) বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি।

২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক আইনগত সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা ও আইনি জটিলতায় হল উদ্ধার কার্যক্রম থমকে থাকে।

এদিকে বারবার হলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলেও হল উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। কেরাণীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের ঘোষণার পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের সম্পত্তি কর্মকর্তা কামাল হোসেন সরকার বলেন, ‘আমরা এখন নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে ব্যস্ত। নতুন ক্যাম্পাসের কাজ করছি। পুরাতন হলগুলো নিয়ে কোনো তথ্য নেই।’

চলমান মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কাগজপত্রের ঝামেলা আছে বলে জানান।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টা দপ্তরের প্যানেল ল-ইয়ার এড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘হল সংক্রান্ত মামলাগুলো সরকার দেখছে। এগুলো সরকারি সম্পত্তি হওয়ায় সরকার মামলাটা চালাচ্ছে। এই মামলার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানা নেই। তবে আমরা কোনো কাগজপত্র পাইনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কমিটি হয়েছিল, সেই রিপোর্টও আমাদের দেয়া হয়নি। এখন যেহেতু নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হয়েছে এবং সেখানেই হল হবে, তাই এসব পুরনো জায়গাগুলোতে হল হওয়ার সুযোগ হবে বলে মনে হয় না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক বলেন, ‘আমাদের যেসব হল রয়েছে, সেগুলো বসবাস উপযোগী কিনা তা সরজমিনে দেখার জন্য প্রক্টর ও এস্টেট অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা রিপোর্ট জানালে ব্যবস্থা নিব। আমাদের ছাত্রীদের জন্য অনেক কষ্টে অর্জিত হলে ১২শ জনকে থাকার ব্যবস্থা করেছি৷ নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হলে একাডেমিক ভবনের পাশাপাশি হলগুলোর বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর